অমর বন্ধন || অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় || সাহিত্যগ্রাফি - Songoti

অমর বন্ধন || অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় || সাহিত্যগ্রাফি

Share This

এই সরমা, আদা রসুনগুলো তাড়াতাড়ি বেটে দে, আমার পাঁচ রকম ভাজা তো হয়ে এলো মাংস টা ম্যারিনেট করতে হবে তো. 

 আমি তো মানুষ , আমার দুটো হাতে আর কত তাড়াতাড়ি করবো?

রেগে গেলি ?  আজ এতদিন পর তোর কাকু দুটো পেট ভরে ভাত খাবে.  ওনার প্রিয় সব রান্নাগুলো আজ করছি. একটু হাত চালা.

তুমি পারো ও বটে !

এই বলে সরমা আদা রসুন বাটায় মন দিল.


আজ একবছর পর সুবিকাশ ভাত খাবে.  দীর্ঘ ছেচল্লিশ  বছর সুবিকাশ ও সুনেত্রার একসাথে পথ চলা.  এতবছর ধরে দুজন দুজনকে একটু একটু করে চিনেছে .  সুনেত্রা যখন প্রথম এবাড়ির বৌ হয়ে এসেছিলো তখন তার বয়স মাত্র কুড়ি , সদ্য ফোটা একটা ফুল.  ভালো করে তরকারি ও কাটতে পারতো না. প্রথম যেদিন রুটি বেলেছিল এ বাড়িতে এসে............  সে কথা মনে পড়লে সে আজও হেসে ফেলে. কিছুতেই রুটি গোল হচ্ছে না কোনটা আফ্রিকা কোনটা চীনের ম্যাপ হয়ে যাচ্ছে নয়ত ছিঁড়ে যাচ্ছে .  সে তো ঘেমে নেয়ে একশা !

এদিকে সুবিকাশ তাড়া দিচ্ছে.  তার নাকি পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে. অতঃপর মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিলেন তার শাশুড়ি মা.  এরপর একটু একটু করে তাকে নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছেন মামনি . এজন্য সে ভীষণ ভাবে ঋণী মামনির কাছে.

তার নিজের মায়ের কাছ থেকে ঘর সংসারের কিছুই সে শিখে আসেনি. সে ছিল মা বাবার একমাত্র মেয়ে. বাড়িতে এক গ্লাস জল ও গড়িয়ে খেতে হয়নি. সে নিজের পড়াশোনা , গান নিয়েই ব্যস্ত থাকতো.  বি. এ পরীক্ষা দিয়েই তার বিয়ে হয়ে যায় ব্যাঙ্ক চাকুরে সুবিকাশের সাথে.  এ বাড়িতে এসে সে মামনির মেয়ের অভাব পূরণ করেছে. মামনির খুব মেয়ের শখ ছিল কিন্তু পরপর দুই ছেলে হবার পর মেয়ের আশা মনেতেই রেখে দিতে হয়েছিল তাকে.  সুবিকাশের দাদা সুপ্রকাশ ভীষণ ভালো ছিল পড়াশোনায়.  খড়্গপুর আই. আই. টি থেকে পাশ করে এম. এস করতে সেই যে আমেরিকা গেলো আর ফিরতেই পারলো না. তার বড় জা অরুন্ধতী বিয়ের পর থেকেই আমেরিকায়. দু তিন বছর অন্তর দিন পনেরর জন্য এখানে আসে তাও বাপের বাড়ি, আত্মীয়দের বাড়ি, এখানে ওখানে করতেই সময় চলে যায় তাই মামনির সাথে সেভাবে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে নি .

সুনেত্রা এ বাড়িতে এসে এম. এ পাশ করেছে. মামনির উৎসাহে বি. এড করে স্কুলে চাকরি করেছে.  ঝিমলি হবার পর সে তো চাকরি ছেড়ে দেবেই ঠিক করেছিল কিন্তু মামনির অভয়বাণী তে সে পুরো চাকরি শেষ করতে পেরেছে.

সত্যি ঝিমলির কোন কিছু নিয়েই তাকে ভাবতে হয়নি.  ঝিমলি কে স্কুল বাসে তোলা, নামানো,  নাচের ক্লাস , টিউশন.....  সবেতেই ঠাম্মি. মেয়েটা ও এমন ঠাম্মি ন্যাওটা ছিল যে তিন বছর বয়স থেকেই ঠাম্মির কাছে শোয়া আরম্ভ করল.  তার কাছে শুতে ডাকলেই বলত তুমি গল্প শোনাও না ঠাম্মি আমাকে কি সুন্দর গল্প বলে ঘুম পাড়ায়. সুবিকাশ ও বলত ওকে ঠাম্মির কাছেই শুতে দাও. সারাদিন আমিও তো আমার মিষ্টি বৌ টাকে কাছে পাই না.


আজ কত বছর হয়ে গেলো  ! ঝিমলিও ছেলে বর নিয়ে মুম্বাইতে সুখে সংসার করছে.  ঝিমলির বিয়ের পর ও সুনেত্রা অত ভেঙে পড়েনি কিন্তু মামনির মৃত্যুতে সে যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলো  !

 সুনেত্রা আজও ভাবে উনি কি শুধু ওর শাশুড়ি ছিলেন নাকি মায়ের চেয়েও বেশী কিছু ?  সে নিজের মা বা সুবিকাশ কেও যা বলতে পারতো না তা অকপটে মামনিকে বলতে পারতো. সুবিকাশ তো মাঝেমাঝেই অভিযোগ করতো যে তুমি ও তোমার মেয়ে আমার মায়ের সব ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছো.  মা আমাকে এখন আর ভালোই বাসে না.  তার হৃদয় জুড়ে শুধু ছোট বৌমা আর নাতনি !


  আজ এক বছর পর সুবিকাশ ভাত খাবে. ও ভীষণ খেতে ভালোবাসে.  হার্টের সমস্যা দেখা দেবার পর ডাক্তার যখন খাসির মাংস খেতে বারণ করলেন তখন সুবিকাশ বলেছিল আমি ভাত খাওয়াই ছেড়ে দেব.  খাসির মাংস , ইলিশ মাছ , রসগোল্লা , রসমালাই সবই ওর প্রিয়.


  আজ সুনেত্রা মন দিয়ে রান্না করেছে সুবিকাশের সব প্রিয় পদ.  পটল ভাজা , বেগুন ভাজা , আলু ভাজা , সর্ষে ইলিশ,  মুসুর ডাল , ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক ,  খাসির মাংস,  খেজুর আমসত্ত্বর চাটনি........ শেষ পাতে রসগোল্লা ও রসমালাই.


সমস্ত খাবারগুলো সুন্দর করে বাটিতে সাজিয়ে , থালায় পাঁচ রকম ভাজা দিয়ে ভাত বেড়ে ঘরে সুবিকাশ কে ডাকতে গেল সুনেত্রা.


ঘর থেকে সুবিকাশের বাঁধানো ছবিটা এনে সামনে রাখলো.


আজই যে সুবিকাশের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী   !!!

1 comment:

  1. অনুভূতি প্রকাশ করতে সময় লাগছে.. ভণিতা বিহীন সাবলীল লেখা যা মনে থেকে যাবে আজীবন

    ReplyDelete