সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ || অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় || সাহিত্যগ্রাফি - Songoti

সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ || অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় || সাহিত্যগ্রাফি

Share This
অফিসের সামনে গত কয়েকদিন ধরে একটি ভিখারি মাকে দেখছে রাতুল । কোলে বছর ছয়েকের একটি নির্জীব ছেলে । মুখে কাপড়ের মাস্ক লাগানো , ঢুলুঢুলু চোখ । ছেলেটির ব্রেন টিউমার হয়েছে । ডাক্তার অপারেশন করতে বলেছেন কিন্তু লাখ দুয়েক টাকা লাগবে অপারেশনের জন্য । সবাই সাধ্যমতো সাহায্য করছে ।
   

         গতবছর রাতুলের একমাত্র ছেলে রিপনের ও ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছিল । হটাৎ খেলতে গিয়ে রিপন মাঠে অজ্ঞান হয়ে যায় । বন্ধুরা ওকে বাড়িতে দিয়ে যায় । অফিস থেকে ফিরে রাতুল ওকে ডাক্তার ব্যানার্জীর কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবু সিটি স্ক্যান করতে বলেন । রিপোর্টে দেখা যায় ব্রেন টিউমার । এই শুনে তো রিপনের মা পর্না একদম ভেঙে পড়ে । একদিকে ছেলে অপরদিকে বৌ !  রাতুলের বন্ধুরা তখন ভীষণ সাহায্য করেছিল । সাত দিনের মধ্যেই ওরা রিপনকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের NIMHANS এ যায় । ওখানকার ডাক্তাররা সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অপারেশন করে দেন এবং বলেন যে মাস দুয়েকের মধ্যে ও একদম স্বাভাবিক হয়ে উঠবে । বছরখানেক পর একবার চেকআপ করাতে আসতে হবে । সামনের মাসেই ওরা রিপন কে নিয়ে আবার যাবে । এই একবছরে কোনরকম অসুবিধা হয় নি । ডাঃ ব্যানার্জী ও অভয় দিয়েছেন ।

          এই বাচ্চাটিকে দেখে রাতুলের খুব মায়া হলো । প্রথমদিন ও বাচ্চাটির মায়ের হাতে পাঁচশ টাকা দেয় । দিন দুই পর টিফিনে চা খেতে বেরিয়ে দেখে বাচ্চাটিকে নিয়ে ওর মা চায়ের দোকানের পাশেই বসেছে । রাতুল এগিয়ে গিয়ে ওর মাকে বলে এর মধ্যে ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা । মা একটি প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দেয় । রাতুল দেখে সেটি ডাঃ দাস বলে একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের । সেখানেও সিটি স্ক্যান করতে বলা হয়েছে । রাতুল বাচ্চাটিকে নিয়ে আগামীকাল ডাঃ ব্যানার্জীর কাছে যাবে বলে কথা দেয় । অফিসের বন্ধুরা বলে - কি দরকার এসব উটকো ঝামেলা কাঁধে নেবার ? পারলে দু একশ টাকা সাহায্য কর , ব্যস !

       রাতুলের মন মানে না । বাচ্চাটিকে দেখে ওর অসুস্থ অবস্থায় রিপনের মুখটা মনে পড়ে  যাচ্ছে । অফিস থেকে ও সোজা ডাঃ ব্যানার্জীর চেম্বারে যায় ।  ডাঃ ব্যানার্জী সত্যিই দয়ালু । ওর মুখ থেকে বাচ্চাটির কথা শুনে অর্ধেক মূল্যে সিটি স্ক্যান করতে রাজি হয়ে যান । একরাশ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরে পর্না কে সব জানায় । পর্না সব শুনে বলে - সিটি স্ক্যানের টাকাটা তুমিই দিয়ে দিও । রাতুল বলল - সে আর  বলতে ........

পরদিন তাড়াতাড়ি অফিস গিয়ে বসকে বলেই চায়ের দোকানে আসে রাতুল । ডাক্তারবাবু এগারোটার মধ্যে যেতে বলেছেন । চায়ের দোকানের পাশে বা প্রথমে যেখানে বসত বাচ্চাটি সেখানেও খোঁজ করে রাতুল কিন্তু কোথাও পায় না । পাশাপাশি অন্যান্য ভিখারিদের জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পায় না । ব্যর্থ মনোরথ হয়ে অফিসে ফিরে আসে রাতুল । মনটা ভীষণ খারাপ তার । মনে মনে ভাবে হয়ত বাচ্চাটির শরীর খুব খারাপ হয়েছে তাই আসতে পারে নি । ওতো ওর ফোন নম্বর একটা কাগজে লিখে বাচ্চাটির মায়ের হাতে দিয়েছিল । একটা ফোন করলেই তো ওরা যেখানে থাকে সেখানে গিয়েই বাচ্চাটিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারতো ও । অবশ্য গরীব নিরক্ষর মানুষের কি এতো বুদ্ধি থাকে !

       এরপর মাসতিনেক কেটে গেছে । বাচ্চাটির কথা প্রায় ভুলতে বসেছিল রাতুল । আজ হটাৎ  অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় তাদের স্টেশনের বাইরে বাচ্চাটিকে দেখতে পায় রাতুল । সেই একইভাবে অন্য এক মহিলার কোলে শুয়ে আছে বাচ্চাটি । রাতুল সামনে গিয়ে ভালো করে বাচ্চাটিকে দেখে মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করে - আপনি কি ওর মা ?
 উত্তরে মহিলা জানান - হ্যাঁ ,  আমার ছেলের ব্রেন টিউমার হয়েছে কিছু সাহায্য করুন । হাতে তিনমাস আগের ডাঃ দাসের সেই প্রেসক্রিপশন । রাতুল চেপে ধরতেই মহিলাটি বাচ্চাটিকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায় । রাতুলের চিৎকারে ও অন্যান্য যাত্রীদের সহযোগিতায়  বাচ্চা সমেত মাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় তারা ॥

পরে পুলিশি রিপোর্টে জানা যায় এটিও এক ধরনের ব্যবসা । হারিয়ে যাওয়া বা চুরি করে এরকম ছোট বাচ্চাদের নিজের জিম্মায় নিয়ে আসে আসগর ও তার শাকরেদরা । তারপর বাচ্চাগুলোকে রোজ সকালে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে এই ভিখারি মায়েদের হাতে তুলে দেয় । দিন প্রতি বাচ্চার ভাড়া আড়াইশ টাকা ।  এই তথাকথিত মায়েরা সারাদিন বাচ্চাগুলোকে নিয়ে ভিক্ষে করে বেশ ভালোই রোজগার করে কারন এইরকম রোগের কথা শুনে মানুষ ভালোই টাকা দেয় ।  আড়াইশ টাকা আসগর কে দিয়েও ভালোই থাকে তাদের হাতে । এর জাল বিছানো সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী । পুলিশ আসগরদের পুরো দলটিকেই শনাক্ত করতে পেরেছে । আসগর অবশ্য গা ঢাকা দিয়েছে তবে পুলিশ কমিশনার বলেছেন অচিরেই আসগর ধরা পড়বে ॥ 

No comments:

Post a Comment