আরে ফুডাইসনা || সুভাষ কর || সাহিত্যগ্রাফি - Songoti

আরে ফুডাইসনা || সুভাষ কর || সাহিত্যগ্রাফি

Share This


বছর পঁচিশ আগের এক দেওয়ালীর সন্ধ্যে। আমি বউ-বাচ্চা নিয়ে আগরতলায় আমাদের বাড়ী থেকে শ্বশুরবাড়ীর পাড়ায় একটা কালীপূজোর নেমন্তন্নে গিয়েছিলাম। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ী ফেরার পথে রিক্সায় রামনগরের একটি বড় রাস্তা দিয়ে আসছিলাম। ফাঁকে ফাঁকে রাস্তার দুপাশে কাঁচা বাড়ীগুলোর ভেতরের উঠোন বা পাকাবাড়ীগুলোর ছাদ থেকে নানা আলোর বাজির রোশনাই দেখা যাচ্ছিল। আর শব্দবাজির তো কথাই নেই, কখন যে কোন্‌ দিক থেকে আওয়াজ আসছে তার ঠিক নেই। তবে মূল রাস্তার উপর কোন ঝামেলা না দেখায় মনটা ভাল লাগল।

আমরা একটা বিশেষ জায়গায় এসে পৌঁছুলে সামনের দিক থেকে নানা ধরণের শব্দবাজির আওয়াজ ক্রমে তীব্রতর ও দ্রুততর হতে লাগল। তখন আগরতলায় প্রায় সব রিক্সার ‘বডি’ই সাইজে খুব ছোট ছিল। আট এবং চার বছরের বাচ্চাদু’টো আমাদের ঊরুতে বসা ছিল বলে ওদের শরীরের অনেকটা অংশই রিক্সার ‘হুড’ এর কাভারে ছিল না। আমার বউ ভয়ে ভয়ে বলল, “কিগো, বাজির ছিটকা আইয়া বাচ্চাডির উপ্‌রে পড়ত না ত?” আমি সাহস দিয়ে বললাম, “না না; বাড়ীর বাইরে আইয়া ত আর কেউ ফুটাইতাসে না; এইবার ত সরকার থিক্যা রাস্তায় বাজি ফাটানি একদম নিষেধ কইরা দিছে”। বয়স্ক রিক্সাওয়ালা সামনে তাকানো অবস্থায়ই তার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া পেছন দিকে ছুঁড়ে দিল, “কি যে কন্‌ বাবু, আর রইছে সরকাররে ডরানি ! অক্ষনে ত শুধু খেলার আগে গাউ গরম করতাছে, আসল খেলাডা ত রাস্তাতেই হইব। বুঝলেন না, অত অত টাকার বাজি কিন্‌ছে, মাইন্‌সের চোখের গুঁড়িত আইন্যা না দেখাইলে চলব? তবে চিন্তা কইরেন না, আমি নজর রাখতাছি। বাজির সামনে আপনেরারে ফালাইতাম না”। বউ আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমার চেয়ে রিক্সাওয়ালার জ্ঞান-বুদ্ধিতে আস্থা রাখাটা সে এই মুহূর্তে ঢের বেশী নিরাপদ মনে করছে।

যাক, একটু পরেই দেখা গেল সামনে গোটাকয় ছেলেমেয়ে একটি বাড়ীর ভেতর থেকে দৌঁড়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে। ওদের হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি সহ নানা রকমের বাজির প্যাকেট। কিছু বয়স্ক মহিলা-পুরুষও পেছন পেছন বেরিয়ে এল। রিক্সাওয়ালার ভবিষ্যত-বাণী বুঝি সত্যি হয় হয় ! তবে কোন্‌ আইটেমটা আগে ফাটানো হবে তাই নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হতেই মনে হল নিশ্চিন্তে পার হয়ে যেতে পারব। কিন্তু না, একটা বেয়াড়া ছেলে তার সুখী পরিবারের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে হঠাৎ-ই রাস্তায় কয়েকটা চোকলেট-বোমা ছুঁড়ে মারলে সারা এলাকা যেন কেঁপে উঠল। রিক্সাওয়ালা কিন্তু ততক্ষণে রিক্সা থামিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার প্রতি একটু আগে জন্মানো ঈষৎ ঈর্ষা এবার কৃতজ্ঞতায় পাল্টে গেল।

রিক্সাওয়ালা আবার চলার উদ্যোগ নিতেই আমি বললাম, “ঝুঁকি লওনের দরকারটা কি ভাই? পরেই যাও না”। “কন্‌ কি বাবু, আমি সারাডা রাইত এইখানে আপ্‌নেরারে লইয়া বইয়াই থাকুম নাকি? আরে, চিন্তা কইরেন না, দেইখ্যা শুইন্যাই যামু......” রিক্সাওয়ালা কথাটা শেষ করতে পারল না; বাঁশের বেড়া দেয়া একটা বাড়ীর ঢেউটিনের খোলা গেইট বরাবর এসে পড়া রিক্সাটার সামনের চাকার নীচে জ্বলন্ত মরচে-বাজির কয়েকটা আস্ত ছড়া এসে পড়ল। ছড়ার বাজিগুলো সবে একটা-দু’টো করে ফাটা শুরু হয়েছে। আমার বউ ভয়ে “অ্যাই অ্যাই” চীৎকার করে উঠল। রিক্সাওয়ালা কোনমতে রাস্তার পাশে খালের ধারে রিক্সাটাকে টেনে নিয়ে গেলে আগুনের ফুলকি কারো গায়ে এসে পড়ার থেকে আমরা বেঁচে গেলাম। পুরো ছড়াগুলো শেষ হতে বেশ সময় লেগেছিল। তবে আমার এখনো মনে পড়ে, বাচ্চারা এত ভয় পেয়েছিল যে কাঁদতে পর্যন্ত পারছিল না ! যাই হোক, রাগে আমার সারা শরীর কাঁপছিল। আমি মেয়েকে কোল থেকে সরিয়ে তার মায়ের কাছে রেখে রিক্সা থেকে নেমে সরাসরি খোলা গেইট দিয়ে ওই বাড়ীতে গিয়ে ঢুকলাম। আমার বউ এবং সঙ্গে রিক্সাওয়ালাও, পেছন থেকে প্রচুর হাঁক-ডাক করছিল - কিন্তু আমি গ্রাহ্যই করলাম না।

আশ্চর্য, বাড়ীতে ঢোকার সময় ভেতরে গেইটের কাছাকাছি কাউকেই দেখা গেল না। কিছুটা এগিয়ে যখন বড় উঠোনটায় পৌঁছুলাম, মনে হল কারা যেন দ্রুতপায়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। আমি ডাকলাম, “বাড়ীতে কে আছেন?” কিছুক্ষণ কোন উত্তর নেই। আবার বললাম, “কেউ আছেন? দয়া কইরা একটু বাইরে আইবেন?” বেশ কিছুক্ষণ পর এক মধ্যবয়স্কা মহিলা বেরিয়ে এলেন। আমি কোন ভূমিকা না করে সরাসরি বলে ফেললাম, “মাসীমা, আপ্‌নের বাড়ীর কেউ বাড়ীর ভিতর থিক্যা রাস্তায় আমরার রিক্সার নীচে জ্বলন্ত মইরচা বাজির ছড়া ছুঁইড়া মারছে, আর অখন আইয়া ঘরে ঢুইক্যা গেছে। আমার বাচ্চা-দুইটার কেবল একটুর লাইগ্যা কিচ্ছু হইছে না”। মহিলার প্রতিক্রিয়া, “অ্যা?, ইতানে আবার মারছে? ইতানরে বার বার কই বুলে ফুডাইসনা, তব ফুডাইব। কি যে যন্ত্রণা! হেইদিকে দেখ, আমার আবার ঠাকুর-নিদ্রা দেওনের সময় যায় গা” - বলে নির্বিকারে উনি উঠোনের এককোণে ঠাকুর-ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলেন। আমি রাস্তা আটকে বললাম, “দাঁড়ান মাসীমা, যান কই, আগে ইডার বিচার কইরা যান। নইলে ঠাকুরে আপ্‌নের পূজা লইব ভাবছেন? দুইটা বাচ্চার জীবন লইয়া কথা”। ভদ্রমহিলা আমার কথায় যেন একেবারে অবাক হয়ে গেলেন; বোধহয় জানা নেই চেনা নেই একজনের কাছ থেকে এমন কথা আশাই করেন নি – যা গেলাও যায় না আবার ফেলাও যায় না। একটু সময় কি ভেবে পরে আমাকে বললেন, “একটু দাঁড়াও বাবা, আমি পুলাপানডিরে ডাকতাছি”। বলেই জোরে ডাকতে লাগলেন, “অ্যাই বাবাই-টুকাই, অ্যাই রনি-বনি, সব্বে এইদিকে আয়, আজগা তরারে দেখামু মজা”।

আমার রাগ অনেকটাই কমে গেল। মনে মনে ভাবলাম, বেশ একটা কাজ হল তাহলে ! কিন্তু অনেকক্ষণ অব্দি কেউ বেরিয়ে এল না দেখে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। ওদিকে আমার বউ-বাচ্চা যে রিক্সায় বসে আছে ! রিক্সার বাড়তি ভাড়া দেবারও তো একটা ব্যাপার আছে। “ঠিক আছে মাসীমা, আপনে যখন দায়িত্ব লইছেন, আমি নিশ্চিন্ত মনে যাইতাছি। আসলে কি জানেন, এই রকম চললে তো যেকোন সময় যেকোন দুর্ঘটনা ঘইট্যা যাইতে পারে, তাই আপ্‌নেরে কওন আর কি” - বলে আমি গেইটের দিকে রওয়ানা দিলাম। এদিকে বেশ টের পেলাম আমায় ফেরত আসতে দেখে চারটে ছেলে সাহস করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। মাসীমা তখনো উঠোনে দাঁড়ানো। কৌতূহল হল, মাসীমা বাচ্চাদের কেমন শাসন করে একটু দেখেই যাই। ইচ্ছে করেই নিজের হাঁটার গতি কমালাম আর আড়চোখে তাকিয়ে কানটা পেতে রাখলাম। শুনলাম মাসীমা বলছেন, “তরারে বার বার কই বুলে ফুডাইসনা, তব তরা ফুডাইবি...”। ছেলেগুলি কোন পাত্তা না দিয়ে আবার বাজিটাজি নিয়ে আগুন দেবার উদ্যোগ নিল। এবার ভাবলাম নিজেই এদের কিছু বলা দরকার। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গেইটে দাঁড়ানো আমাদের রিক্সাওয়ালার জোরালো আওয়াজ, “বাবু তাড়াতাড়ি চলেন, বৌদি ডাকতাছে। অনেক দেরী হইতাছে ত”।

তারপর ... সেই রিক্সায় মাত্র কিছুটা এগিয়ে এসেছি। পেছনে সেই গেইটের কাছেই রাস্তায় এবার একটা চোকলেট-বোমা ফাটার প্রচণ্ড আওয়াজ। আর পরমুহূর্তেই সৃষ্টি হওয়া নীরবতা ভেদ করে আবার একটা আহ্লাদি শাসনের ক্ষীণ নারীকন্ঠ ভেসে আসে - “আরে ফুডাইসনা”।

আজ এতদিন পরেও বর্তমানে আমার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে, শুধু দেওয়ালীতেই নয় – অন্য আরো বহু উচ্ছৃংখলতা দমনের প্রদর্শনীতেও - আমি যেন সেই আহ্লাদি শাসনের একই শব্দসমষ্টি শুনতে পাই - “আরে ফুডাইসনা”।

No comments:

Post a Comment