ফুলেদের ঝগড়া || নিশা ঘোষ দস্তিদার || সাহিত্যগ্রাফি - Songoti

ফুলেদের ঝগড়া || নিশা ঘোষ দস্তিদার || সাহিত্যগ্রাফি

Share This

ফুলের বাগানে নিত্য তিরিশ দিন ঝগড়া লেগেই থাকে। কোন কোন দিন ঝগড়া এত বেশি হয় যে, হাতাহাতি হতে হতে শেষ পর্যন্ত চুল ছেঁড়া ছিড়ি হয়ে যায়। এক একজন গোঁসা করে মুখ ভার করে থাকে। কেউই কারোর সাথে কথা বলে না। খাওয়া দাওয়া করে না। রান্না-বান্না কাজ-কর্ম সব‌ই পড়ে থাকে।
    যে যার মতো মান করে থাকে। কে আর কার মান ভাঙাবে? কেউই তো কারোর কাছে নীচু হবে না। 
অবশেষে জোনাকী আসে। সাথে নিয়ে আসে মান ভাঙানোর আলো। মুচকি হেসে, আলোর পরশ বুলিয়ে দিয়ে মান ভাঙাতে চায়।
     মুখরা গোলাপ খরখরে গলায় বলে ওঠে  "বলতো জোনাকী বৌদি, আমাদের মধ্যে কে বেশি দেখতে সুন্দর?"
     লাজুক রজনী গন্ধা মিষ্টি সুরে জিজ্ঞাসা করে  "বলতো বৌদি, আমাদের মধ্যে কার গন্ধ বেশি মিষ্টি?"
    প্রভাবশালী গন্ধরাজ গম্ভীর গলায় বলে ওঠে  "বৌদি, আমার দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে বিচার করে বলতো, গন্ধের রাজা কে?"
    নম্র স্বভাবা মল্লিকা আর অতসী একসাথে বলে  "বৌদি আমাদের মধ্যে কে বেশি ফর্সা?"
    জোনাকী বৌদি পড়ে ভীষণ  বিপদে। কাকে ছেড়ে কাকে ভালো বলবে।
    পানের রসে ঠোঁটটি লাল করে, মিষ্টি হেসে জোনাকী বৌদি বলে  "দেখ গন্ধরাজ ঠাকুরপো, তুমি তো আমার দেওর হ‌ও। আর ওরা আমার মিষ্টি মিষ্টি ননদ। তা তুমি বাপু মেয়েদের সাথে নিজেকে তুলনা করতে এসেছ কেন? যাও যাও, তুমি যাও। তোমার কী আর কোন কাজ নেই?"
    গন্ধরাজ বলে ওঠে  "কেন, দেওর বলে কি সুন্দর হতে মানা আছে?"
    জোনাকী বৌদি ভীষণ চালাক। কথা বেশি বাড়াতে চায় না। তার আলোর শিখাটুকু গন্ধরাজের মুখের উপর ফেলে বলে  "ঘরে যাও। যখন সময় হবে, তখন আমি তোমাকে সর্বপ্রথম রাজা বলে ঘোষণা করব।"
     কি আর করে গন্ধরাজ। মুখ নীচু করে ঘরে ফিরে যায়।
    গোলাপ, রজনীগন্ধা, মল্লিকা, অতসী সবার দিকে তাকিয়ে জোনাকী বৌদি বলে  "তোমরা সবাই সুন্দর,সবাই মিষ্টি। আর মন খারাপ নয়। যাও, রান্না-বান্না করে, খাওয়া দাওয়া সেরে, টেনে ঘুম লাগাও। সারাদিন না খেয়ে চেহারা গুলোর যা অবস্থা হয়েছে।"
    খাওয়ার কথা শুনে ওদের পেট খিদেয় জ্বলে উঠলো। ঝগড়ার কথা ভুলে রান্না, খাওয়ার কাজে মন দিল। এটা নিত্যকার ঘটনা। জোনাকী বৌদি আর পারে না ওদের মান ভাঙাতে।
    জোনাকী বৌদির বিচারে ওরা খুশি হয় না। সবাই মনে মনে গুমরোতে থাকে। কে বেশি সুন্দরী এ কথা জোনাকী বৌদি কখন বলে না। বৌদিটা একেবারে যাচ্ছে তাই।
    সকাল হলে যেই মৌমাছি আসে ফুলের বাগানে মধু নিতে, অমনি ডালিয়া বলে  "বলতো মৌমাছি দাদা, আমাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী?"
    টগর ফোড়ন কেটে ওঠে  "তোকে যদি শ্রেষ্ঠ সুন্দরী বলে, তবে কি তুই বেশি মধু দিবি?"
    ডালিয়া বলে  "তা কেন দেব?"
    মৌমাছি জানে এক্ষুনি ঝগড়া লাগবে। তাই মধু নেওয়া ফেলে উড়ে পালায়। মাথা খারাপ নাকি যে মেয়েদের ঝগড়ার মধ্যে থাকবে।
    নক্সী দুটো ডানা মেলে প্রজাপতি যেই এসে বসে চাঁপা ফুলের রেণু গায়ে মাখতে, অমনি চাঁপা উদাস গলায় বলে ওঠে  "আমাকে যদি ফুলেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসন দিতে পার, তবেই তোমাকে আমার রেণু গায়ে মাখতে দেব। নচেৎ নয়।"
    মুচকি হেসে প্রজাপতি বলে     "কেন তোমায় মিছিমিছি শ্রেষ্ঠ আসন দিতে যাব? আমার মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে নাকি?"
    চাঁপার কাছ হতে অতসীর কাছে চলে আসে। সেখানেও একই কথা শোনে। অতসীর ধারণা সে সবার চাইতে বেশি ফর্সা।
    ভয়ে এখন আর কেউ ফুলের বাগানে আসে না। তা বলে কি ওদের ঝগড়া বন্ধ হয়েছে? না,তা হয় নি।
    সবার ভেতরে একটা গোপন রাগ রয়েছে। সূর্যমুখী তো কোন সময় ই ঝগড়ার মধ্যে থাকে না। সে নিজেকে সব সময় সবার চেয়ে আলাদা মনে করে। তাই কারোর সাথে কথা বলে না বেশি।
    গোলাপের আবার চুপ করে থাকাটা সহ্য হয়না। কারণে-অকারণে সূর্যমুখী কে ঠেস্ মেরে কথা বলে।
    একদিন সবাই মিলে ঠিক করল, রাজার কাছে বিচার চাইবে। যা হোক একটা হেস্তনেস্ত হ‌ওয়া দরকার। এভাবে আর বাস করা যায় না। তাছাড়া অভিমান করে, খাওয়া দাওয়া বন্ধ করতে করতে সবার চেহারাতেই ভাঙন ধরেছে।
    শীত চলে গেল। এলো ঋতুরাজ বসন্ত। রাজার আগমনে সবাই ভেসে চলল খুশির জোয়ারে। ভাসতে ভাসতে রাজ দরবারে গিয়ে হাজির। সবাই বলল  "বল রাজা, আমাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী?"
   ঋতুরাজ সমস্যায় পড়ল। কাকে খুশি করবে। বারোটা মাসের মধ্যে, দুটো মাস
তার নিজস্ব। এই অল্প সময়টুকুতে তার তো সবাই কে দরকার। তাই হেসে বলল  "বিশ্বের শক্তির যে আধার তোমরা তার কাছে যাও। তিনিই পারবেন তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে। তিনিই আমাকে পাঠান প্রকৃতির সভায়, ফুলেদের মেলায় কদিন আমোদ-প্রমোদ করতে। তোমাদের সৌন্দর্য বিচার করতে নয়।"
   পূর্ব আকাশে যখন রবি রাজ উঁকি দিল, তখন সবাই তার কাছে বিচার চাইল  "বলুন পিতা, আমাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দর? আপনাকে বলতেই হবে।"
    মুচকি হেসে রবি রাজ বলল  "তোমরা তো নিজেরাই জানো এ প্রশ্নের উত্তর।"
    সবাই একসাথে বলল  "না, আমরা জানি না। আপনি আমাদের জানিয়ে দিন।"
    সবাই কে শান্ত করে পিতা জিজ্ঞেস করলেন  "আমার আলো, আমার স্নেহ, ভালোবাসা তোমরা কী সমান ভাবে পাও?"
    "হ্যাঁ পিতা পাই।"
     "তাহলে তোমাদের পিতা, তোমাদের সমান ভালোবাসে। কাউকে কম-বেশি নয়। ঠিক তো?"
    "হ্যাঁ পিতা, ঠিক।"
    "যার গুণ আছে, যে সত্যিকারের ভালো থাকে তো সবাই ভালোবাসে। তোমরা সবাই এক এক গুণের অধিকারিণী। শুধু রূপসীকেই সুন্দর বলা হয় না। গুনবতীকেও সুন্দর বলা হয়। তোমরা সবাই তো দেবতার সেবিকা। কেউ দেবতার কর্নে থাকো। কেউ মস্তকে থাকো। কেউ কন্ঠে থাকো। কেউ হস্তে থাকো। কেউ চরণে থাকো। তোমরা না হলে দেবতা যে স্বয়ং সম্পূর্ণ হন না। তোমরা সবাই সুন্দর। কেউ দর্শনে, কেউ বর্নে, কেউ গন্ধে, কেউ ধৈর্য্যে, কেউ সাহসিকতায়।"
    পিতার বিচারে সবাই খুশি। ঝগড়া মিটে গেল। একসাথে মিলেমিশে থাকে। বসন্ত ঋতুতে ফুলের মেলায় একসাথে নৃ্ত্যে অংশ গ্রহণ করে।

No comments:

Post a Comment