নীল নগর || নিশা ঘোষ দস্তিদার || সাহিত্যগ্রাফি - Songoti

নীল নগর || নিশা ঘোষ দস্তিদার || সাহিত্যগ্রাফি

Share This

পাহাড়ের গা বেয়ে যে সরু নদীটা এঁকে বেঁকে চলে গেছে, সেই নদীর তীরে বাস করত একটা নীল পাখি, তার বৌ,আর সুন্দর সুন্দর ছোট দুটো ছানা। শীতকালে পাহাড়ের মাথায় উঠে ভোরের মিঠে রোদ মাখত তাদের নরম ডানায়। গরম কালে শীতল বাতাস সব ক্লান্তি দূর করে দিত। নদীর জলে স্নান করত।আর খিদে পেলেই নদীর ছোট ছোট মাছের পোনা গুলোকে ধরে খেত। বিকাল বেলা নদীর তীরে বসে, নদীর জলে সূর্য স্নান দেখত।আর দেখতে সাঁঝের আকাশে তারার মেলা।
    কিন্তু নীল পাখির মনে কোন শান্তি ছিল না।ঐ ছোট মাছের পোনা গুলোকে ধরে খেতে তার মোটেই ভালো লাগত না।এক এক সময় তার দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। কিন্তু কী করবে,খেতেই হবে। তাছাড়া আর যে কোন উপায় নেই। রুক্ষ, শুষ্ক পাহাড়ে আর যে কোন খাবার নেই। ছানাদের ফেলে খাবারের খোঁজে বেশি দূর যেতেও পারে না।
    একদিন বিকেল বেলা নীল পাখি নদীর তীরে বসে আপন মনে মাছের পোনাদের খেলা দেখছে  আর মনে মনে ভগবানকে ডাকছে" ভগবান আমার এমন কোন উপায় করে দাও।ঐ সুন্দর সুন্দর পোনাগুলো আমি আর খেতে পারিনা।" এমন সময় শুনতে পেল কে যেন তাকে ডাকছে " নীল পাখি, নীল পাখি।"
চারিদিকে তাকায় সে। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। আবার শুনল " কি রে দেখতে পাচ্ছিস না? নদীর জলের দিকে তাকা, আমাকে দেখতে পারবি।"
  নদীর জলের দিকে তাকিয়ে নীল পাখি দেখতে পেল, একটা বড়ো আকারের মাছ মুখটা বাড়িয়ে রয়েছে। নীল পাখি বলল " তুমি কে?"
  " আমি তোর বন্ধু।"
    " বন্ধু, আমাকে তুমি ডাকছ কেন?"
     " তুই খুব ভাবনায় পড়েছিস দেখছি। মাছের পোনা দের মারতে চাস না, তাইতো। আমার যদি শুনিস, তাহলে তোর কোনো কষ্ট থাকবে না। পাহাড়ের উত্তর দিকে কিছুটা যাবার পর, পাহাড়ের গায়ে একটা ঢালু জমি দেখতে পাবি। ঐ জমিতে খাবার আছে।" বলে মাছটা জলের মধ্যে ডুব দিল।
     পরের দিন খুব ভোরে উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করল নীল পাখি। কিছুটা যাবার পর , বিশাল বড় একটা ঢালু জমি দেখতে পেল। ঐ জমিতে বড়ো বড়ো ঘাস হয়ে রয়েছে। খুব আনন্দ হলো তার। অনেক ঘাসের দানা তুলে নিয়ে এলো বাড়িতে। মাছ আর ধরতে হয় না।
   কত দিন আর চলবে এ ঘাসের দানাতে। খেতে খেতে সব তো শেষ হয়ে যাবে। নীল পাখি ভাবলো ঐ জমিটা চাষ করলে ভালো হতো। সারা বছরের খাবার পাওয়া যেত। ভেবে ভেবে কিছুটা জমিতে ধান চাষ করল। দেখতে দেখতে সোনা ধানে পাহাড়ি জমি ভরে উঠলো।

    নীল পাখির আনন্দের আর সীমা নেই। তার ছানাদুটো এখন জোয়ান হয়ে উঠেছে। সবাই মিলে জমি চাষ করে। কখন ধান। কখন গম। কখন নানা ধরনের শাক সবজি। সুখেই দিন কাটছে তাদের।
    এদিকে একটা হলুদ পাখি পাহাড়ের মাথায় বসে দেখছে যে, নীল পাখি তার জোয়ান দুই বেটাকে নিয়ে পাহাড়ের কোলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটাচ্ছে। ওখানে কি আছে যা দেখার খুব ইচ্ছে হলো। নীল পাখিরা বাড়ি ফিরে যাবার পর, হলুদ পাখিটা পাহাড়ের ঢালে নেমে এলো। দেখে সারাটা জমি সোনালী ধানের ভরে আছে। চাঁদের আলো পড়ে ধানগুলো চিক্ চিক্ করছে। হলুদ পাখিটার মাথায় মূহুর্তে র মধ্যে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সারারাত ধরে পাকা ধানের শীষ গুলো কেটে কেটে মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলো।আর যতটা পারলো বাড়িতে নিয়ে গেল।
    সকালে উঠে নীল পাখি তার ছেলে দের নিয়ে ক্ষেতে এলো। কি সর্বনাশ। তাদের এমন ক্ষতি করল কে? খুব কষ্ট হলো তাদের।এত পরিশ্রমের ফসল মাটিতে মিশিয়ে দিল। তিনজনে মিলে খুঁটে খুঁটে যতটা পারলো তুলে নিয়ে বাড়িতে এলো। সারাদিন নীল পাখির মনে খুব খারাপ।কে তার এই ক্ষতি করল?
   মনে দুঃখ নিয়ে শেষ বেলায় নদীর তীরে গিয়ে চুপটি করে বসে রইলো। এমন সময় আবার কে যেন ডাকল। নীল পাখি জলের দিকে তাকিয়ে দেখে সেই মাছটা মুখ বাড়িয়ে রয়েছে। নীল পাখি বলল" কি বলছ বন্ধু?"
   মাছটা বলল" মনে খুব দুঃখ হয়েছে তাইনা? দুঃখ করিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।যে তোর ক্ষতি করেছে,তার‌ও ক্ষতি হবে" বলে মাছটা ঝুপ করে জলে ডুব দিল।
  নীল পাখি কারোর ক্ষতি চায় না। মনের কথা মাছ বন্ধু কে বলতে পারল না। তার আগেই সে জলে ডুব দিয়েছে।
    হলুদ পাখির মনে শান্তি নেই। সারাদিন শুধু ছট্ ফট্ করছে। কখন রাত হবে।গমের শীষ গুলো বেশ হৃষ্ট পুষ্ট হয়ে উঠেছে।ওগুলো নষ্ট না করা পর্যন্ত স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে থাকতে পারছে না।
   রাত নামার সাথে সাথে হলুদ পাখি, নীল পাখির গমের ক্ষেতে চলে গেল। মনের আনন্দে গমের শীষ গুলো একের পর এক কাটতে লাগল। কাটতে কাটতে একটা শীষ হঠাৎ তার গলার ভেতরে কেমন করে ঢুকে আটকে গেল।আর যায় কোথায়? কিছুতেই গলা থেকে বের করতে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে। মাটিতে পড়ে ছট্ ফট্ করতে লাগলো।
    সকালবেলা নীল পাখি তার ছেলেদের নিয়ে ক্ষেতে গিয়ে দেখে, একটা হলুদ পাখি অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। এদিকে গমের শীষ গুলো মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নীল পাখি ভাবলো, হলুদ পাখিটার বোধহয় খুব কষ্ট।ও যেখানে থাকে, সেখানে নিশ্চয়ই খাবারের খুব অভাব।ওর ও হয়তো ছানাপানা নিয়ে সংসার।তাই খাবারের খোঁজে এখানে এসেছে।আহা, হলুদ পাখিটা যদি মারা যায়, তাহলে ওদের সংসারের কি হবে?
   হলুদ পাখির জন্য খুব মায়া হলো নীল পাখির। সে আর তার ছেলেরা মিলে ধরাধরি করে তাকে নদীর তীরে নিয়ে এলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে মাছ বন্ধু র কথা মনে পড়লো। মনে মনে তাকে স্মরণ করে, নদী থেকে একটু জল তুলে তার মুখে দিয়ে দিল। কিছু সময় পর তার গলা থেকে গমের শীষ বেরিয়ে গেল। হলুদ পাখি প্রাণ ফিরে পেল।
     নীল পাখি বলল" ভাই, তোমার এতো খাবার কষ্ট, তুমি আমাকে বলনি কেন? যাও, তোমার সংসার নিয়ে এখন‌ই এই নদীর তীরে চলে এসো। এখানে আমরা একসাথে থাকব। একসাথে বাঁচবো। একসাথে আরো অনেক বেশি জমি চাষ করব। আমাদের খাবার কোনো অভাব থাকবে না।সুখে শান্তিতে বসবাস করব।
   হলুদ পাখি, নীল পাখিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।বলল" আমি তোমার ক্ষতি করতে গেছিলাম।আর তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়ে, আমাকে এইভাবে ক্ষমা করলে।"
   নীল পাখি বলল" ক্ষমাই তো ধর্ম।আর ধর্ম‌ই সঠিক পথের সন্ধান দেয়।"
   হলুদ পাখি তার সংসার নিয়ে নদীর তীরে এসে বাসা বাঁধলো। তারপর লাল, সবুজ,আকাশী, ধূসর, খয়েরী সবাই একে একে নদীর তীরে চলে এলো।সবাই মিলে চাষবাস করে।আর খাবারের কষ্ট র‌ইলো না। সুন্দর একটা নগর গড়ে উঠলো। সেই নগরে ছানাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য স্কুল তৈরি হলো। চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল গড়ে উঠলো।সব পাখিরা মিলে নগরটার নাম রাখল ' নীল নগর।

No comments:

Post a Comment