দুর্গাভাবী ও ভগৎ সিংয়ের প্রেম | চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য - Songoti

দুর্গাভাবী ও ভগৎ সিংয়ের প্রেম | চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

Share This

প্রেম, ভালবাসা, বিয়ে এসবের মধ্যে নেই, এই বলে একসময় ঘর ছেড়েছিলেন বিপ্লবী ভগৎ সিং কিন্তু, শেষ পর্যন্ত মন থেকে ভালবেসেছিলেন এক বঙ্গললনা়কে। সেই ভালবাসায় না ছিল কোনও অবাঞ্ছিত মোহ বা অন্যায় আবদার। ছিল না শারীরিক চাওয়া-পাওয়ার হিসেবনিকেশও কিন্তু প্রাণ ছিলপ্রেম ছিল আন্তরিক অগ্নিযুগে আগুন নিয়ে খেলা করা বিপ্লবীদের অনেকেই নারীর সঙ্গে প্রেম করাকে অসঙ্গত মনে করতেন। সেই ধারণাই শেষ পর্যন্ত ভগৎ সিংকে ফাঁসির দড়ি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছে, এমনটাই ধারণা গবেষকদের।

ভগৎ সিংয়ের ভাই এবং আরও কিছু বিপ্লবীর সঙ্গে কথা তথ্য সংগ্রহ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দক্ষিণ দিল্লি জেলা কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক তথা দৈনিক হিন্দুস্তান পত্রিকার নিউজ এডিটর বিশ্বামিত্র উপাধ্যায় সে-কথা লিখেছিলেন তাঁর “ভারত কা মুক্তি সংঘর্ষ অউর রুশি ক্রান্তি” বইতে তখন এ-নিয়ে বিশেষ আলোড়ন হয়নি। সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার এই বিশয়ে লেখার পরই অনেকে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন।

ভগৎ সিং বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর থেকে বাংলার বিপ্লবীদের দ্বারা, বিশেষত শচীন্দ্রনাথ সান্যালের দ্বারা প্রভাবিত হন। তাঁদের সংগঠন ‘হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রেভেল্যুশনারি আর্মি’ (এইচএসআরএ)-তে শপথ নেওয়া হয়, ‘নেতার ডাক পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘর ছেড়ে আসতে হবে। পিছুটান চলবে না।’ ভগৎ সিংও এই শপথ নেন। এদিকে ভগতের ঠাকুমা তাঁর বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর পাত্রী দেখেছেন, বিয়ের নির্ধারিত দিনও এগিয়ে আসছে। বাধ্য হয়ে ভগৎ সিং একটি চিঠি লিখে ঘর ছাড়লেন। তাতে লিখলেন, “আমার জীবনের লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। জাগতিক আনন্দে উত্সুক নই। আমার (শিখ ধর্মে) দীক্ষার সময কাকা আমাকে কোনও একটা শপথ নিতে বলেছিলেন। আমি দেশের জন্য জীবন উত্সর্গ করেছিলাম। সেই শপথ মেনে আমি আমার সব সুখ বিসর্জন দিয়ে দেশের কাজে চললাম।”

ভগৎ সিং কানপুরে এসে খবরের কাগজ বিক্রি করতে করতে বিপ্লবীদের দলে আসেন নাম বদলে হন বলবন্ত সিং। বিপ্লবী গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী তাঁকে ‘দ্য প্রতাপ’ পত্রিকায় কাজ দেন। বাড়ির লোকেরা অনেক খোঁজ করে ধরতে পেরে তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

এহেন ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে দুর্গাবতী দেবীর কোনও পরিচয়ই ছিল না। তিনি ছিলেন হিন্দুস্থান সোস্যালিস্ট রিপাব্লিকান আর্মি-র সতীর্থ ভগবতীচরণ ভোরার স্ত্রী। ১৯০৭-এর ৭ অক্টোবর এই বাঙালী পরিবারে দুর্গাবতীর জন্ম। এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয় ভগবতীচরণের সঙ্গে। এর পর স্বামীর সঙ্গে থাকতেন লাহোরে। ১৯২৬ সালে লাহোরেই বিপ্লবী কর্তার সিং সরাবার একাদশ-তম শহিদ দিবস পালনের মধ্যে দিয়েই ভগৎ সিংদের নওজোয়ান ভারত সভার সদস্যা দুর্গাবতী দেবী পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। তার দু-বছর পর, ১৭ ডিসেম্বর ১৯২৮, লালা লাজপত রায়ের হত্যাকারী জে এ স্কটকে হত্যা করতে গিয়ে ভগৎ সিং ও শিবরাম রাজগুরু লাহোরে ব্রিটিশ অফিসার জে পি স্যান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন তার দু-দিন পর দুর্গাবতী ভাবীর বাড়িতে রাজগুরু আর ভগৎ সিংয়ের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন সুখদেব থাপার। ইতিমধ্যে চুল কেটে ফেলেছেন সর্দার ভগৎ সিং, পোশাক বদলে হয়ে গিয়েছেন ভারতীয় সাহেব

বেশিদিন লাহোরে থাকা নিরাপদ নয়। তাই দুর্গাভাবীর পরিকল্পনা মতো এই তিনজন খুব ভোরের ট্রেনে কলকাতার দিকে রওনা দিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভগৎ সিং দুটি ফার্স্ট ক্লাসের এবং একটি থার্ড ক্লাসের টিকিট কাটেন। ফার্স্ট ক্লাসে ভগৎ ও দুর্গাবতী ভাবী স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে কোলে সন্তান নিয়ে ওঠেন, আর রাজগুরু মালপত্র নিয়ে ওঠেন তাদের চাকরের পরিচয়ে। দু-জনের কাছেই ছিল গুলিভরা রিভলভার। সরাসরি কলাকাতায় এলে ধরা পড়তে পারেন বলে তাঁরা কানপুরে নেমে চলে যান লখনৌ। সেখান থেকে রাজগুরু যান বেনারস আর দুর্গাবতী ও ভগৎ সিং আসেন কলকাতায় তার কয়েকদিন পর দুর্গাবতী দেবী ফিরে যান লাহোর

কুলদীপ নায়ারের মতে, একই দলে থাকলেও সুখদেবের সঙ্গে ভগৎ সিংয়ের সম্পর্কে টানাপোড়েন ছিল। ভগৎ সিং ও রাজগুরু দুর্গাভাবীর সঙ্গে পালিয়ে এলেও স্যান্ডার্স-হত্যার পরিকল্পনা যার, সেই সুখদেব থাপার কিন্তু লাহোরেই থেকে গিয়েছিলেন। তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, দুর্গাভাবীর সঙ্গে গভীর ব্যক্তিগত ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়েছেন ভগৎ সিং। এওসঙ্গে কলকাতায় যাওয়া, কিছুদিন থাকা --- এগুলিই ছিল তার সন্দেহের কারণ সেকথা তিনি সংগঠনে প্রকাশও করেছিলেন।

জানা যায়, লাহোর সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে বোমা বর্ষণের পরিকল্পনার সময়ে প্রথমে যে তিনজনকে সেখানে পাঠানোর জন্য বাছা হয়, তাতে ভগৎ সিংয়ের নামই ছিল না। এইচএসআরএ-র বৈঠকে একসময় সুখদেবই ওই অপারেশনের জন্য ভগৎ সিংয়ের নাম প্রস্তাব করেন এই নিয়ে ভগৎ সিং প্রশ্ন তোলায় সুখদেব খোঁচা দিয়ে বলেন, “বিপ্লবের পথে থেকে তোমার কোনও ভূমিকাই নেই। তুমি একজন সুন্দরী মহিলার সুদৃশ্য কেশরাশির ছায়ায় হারিয়ে গেছো” নাম না করলেও সুখদেবের খোঁচাটা ছিল দুর্গাভাবীর দিকেই, যিনি লাহোর থেকে কলকাতার ট্রেনে সফরের সময় ভগৎ সিংকে স্বামীর পরিচয় দিয়ে  কানপুরে যান এবং কয়েকদিন থেকে ফের লখনৌ হয়ে কলকাতা পর্যন্ত সফর করেন। কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, ভগৎ সিংয়ের জনপ্রিয়তায় সুখদেব ঈর্ষান্বিত ছিলেন।

সিপিআই নেতা বিশ্বামিত্র উপাধ্যায় একান্ত আলাপচারিতার বলেছিলেন, সেই সভাতেই ভগৎ সিং ঘোষণা করেন যে, লাহোর অ্যাসেম্বলিতে বোমা বর্ষণে তিনিই নেতৃত্ব দেবেন। সুখদেবের এই খোঁচায় তিনি যে ‘আহত সিংহ’, ভগৎ সিং সে-কথা কেবল দুর্গাভাবীকেই জানিয়েছিলেন। এর পরের ঘটনা সবার জানা। ১৯২৯-এর এ্প্রিলে ভগত দিং, সুখদেব ও রাজগুরু লাহোর অ্যাসেম্বলিতে বোমা ছোঁড়েন। কিছুদিন আত্মগোপনের পর তাঁরা আত্মসমর্পন করেন। বিচারে তাঁদের ফাঁসি হয়

দুর্গাভাবী কিন্তু যারপরনাই চেষ্টা করেছিলেন ভগৎ-সুখদেব-রাজগুরুদের প্রাণরক্ষার। মনে মনে তিনি ভগত সিংকে সত্যিই ভালোবেসেছিলেন, প্রিয় বিপ্লবী হিসেবে তিনি নিজের সোনার গয়না সেই সময়ে ৩০০০ টাকায় বিক্রি করে ভগৎ সিংদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। অনশনে মৃত বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাসের মরদেহ নিয়ে কলকাতার মিছিলে তিনি লাহোর থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন। নিজেই ভগত সিংদের মামলার বিচারক লর্ড হেলিকে হত্যার চেষ্টাও করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। দুর্গাবতীকে গ্রেফতার করা হয়। সেই অপরাধে তিনি তিন বছর কারাদণ্ডও ভোগ করেন। পরে স্বামীকে নিযে তিনি ও আরেক বিপ্লবী সতীর্থ দিল্লির কুতুব রোডেˆহিমালয়ান টয়লেটস’ নামে কোম্পানি চালু করেন। সেখানে পিকারিক অ্যাসিড, নাইট্রো-গ্লিসারিন, মার্কারি ফুলমিনেট দিয়ে বোমা বানানো হতো বিপ্লবীদের জন্য স্বাধীনতার পর দুর্গাবতী দেবী বা দুর্গাভাবী স্বেচ্ছায় নিজেকে রাজনীতির জগত থেকে সরিয়ে নেন। গাজিয়াবাদে এসে বসবাস শুরু করেন, পরে লখনৌতে এসে স্কুল খোলেন। ১৯৯৯-এর ১৫ অক্টোবর অনেক দুঃখ বুকে নিয়ে তিনি প্রয়াত হন।

ভগৎ সিংকে সত্যিই তিনি ভালবেসেছিলেন। সেই ভালোবাসায় সুদৃশ্য ভ্রমরকৃষ্ণ কেশরাশির আড়ালে লুকনোর ভালবাসা ছিল না, ছিল এক বিপ্লবীর প্রতি আরেক বিপ্লবীর আন্তরিক ভালবাসা। ভগৎ সিংদের ফাঁসি তিনি মেনে নিতে পারেননি। বিশেষত, তাঁর নামে খোঁচা দিয়ে লাহোর অ্যাসেম্বলি অভিযানে ভগৎ সিংকে যেতে প্ররোচিত করা, একেবারেই মানতে পারেননি। একবার ভগৎ সিংয়ের ভাইকে তিনি বলেছিলেন, “বিপ্লবীরাই যদি বিপ্লবীদের অন্তর থেকে না চেনে, না বোঝে, তাহলে কি বিপ্লব সম্ভব হয়

No comments:

Post a Comment