আশা দেবীর কথা বলি। আশা দেবী গুজ্জরকেও এই বাংলায় কেউ চেনে না। বাংলায় কেন, তাঁর এলাকার মানুষ ছাড়া কেউ মনে রাখেনি। তোমাদের অনেকের মতোই ওঁর বাড়িও ছিল সবুজ আঁচলে ঘেরা গ্রামে। পাশ দিয়ে বয়ে যেত নদী।
আশা দেবীর জন্ম ১৮২৯ সালে,
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুজফফনগর জেলায় কৈরানা গ্রামে, অনেক ভাঙাচোরার পর এখন যেটি
শামলী জেলায়। শামলী ছিল তখন সমৃদ্ধ তহশীল। শামলী, কৈরানা, পাঞ্চলী, ঘাট, নঙ্গলা,
গগোল-এর মতো ৮৪টা গ্রামে বাস করতেন প্রধানত আশা দেবীর মতো দলিত গুজ্জর জাতির
লোকেরা। গ্রামগুলি পরিচালিত হতো নিজস্ব সমাজ পরিচালন নিজস্ব ‘খাপ’ ব্যবস্থা। নাম
ছিল কল্যাণ খাপ। আজকের খাপ পঞ্চায়েতের ঠিক বিপরীত এক সুশাসন ব্যবস্থা, যার শিকড়
আছে বৌদ্ধ যুগে।
১৮৫৫-র পরবর্তী সময়। দেশে তখনও
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজত্ব। ১৮৫৭। ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডে বিদ্রোহ
করেছেন, ইংরেজ যাকে বলল ‘সিপাই বিদ্রোহ’। সেই বিদ্রোহে যোগ দেওয়া রাজা, নবাবদের
লড়াইকে ‘ক্ষমতা হারানোর ভয়ে বিদ্রোহী সিপাইদের সঙ্গে মিশে শেষবার মাথা চাড়া দেওয়ার
চেষ্টা’ বলে চালাতে চাইল। কিছুতেই স্বীকার করতে চায়নি যে, বিক্ষিপ্তভাবে হলেও
ভারতবাসীর স্বাধীনতা স্পৃহার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তখন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ সেই
লড়াই লড়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন। একথা স্বীকার করলে শুধু ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ যে বলা যায়
না।
ব্যারাকপুরের বিদ্রোহের স্ফূলিঙ্গ পৌঁছে গেল মিরাটে। মিরাট থানার মধ্যেই কল্যাণ খাপ। থানার কোতোয়াল ধন সিং গুজ্জর। ইংরেজ তখন জমির উপর কর চাপিয়ে যেভাবে অত্যাচার করতো, ইংরেজের চাকরি করলেও তা মানতে পারতেন না ধন সিং। গ্রামের থেকে পাওনা ফসল আর অর্থ, যাকে বলা হয় ‘লগান’, বাধ্যমামূলক আদায় করে দিতে হতো। দায়িত্ব থাকতো গ্রামপ্রধানের। এক পয়সাও কম হলে মারধর, পাশবিক অত্যাচার করে গ্রামপ্রধানের জমি কেড়ে নিত। ধন সিং-এর বাবা ছিলে পাঞ্চাল গ্রামে গ্রামপ্রধান, তাঁকেও এমন অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। ধন সিং মনে পুষতেন তাঁর রাগ।
ধন সিং-এর নেতৃত্বে ১০মে রাতে
মিরাটের পুলিশ বিদ্রোহ করে ইংরেজ সেনাদের কোতোয়ালিতেই আটকে দেয়। বিদ্রোহীরা সেনা
নয়, পুলিশ। তাদের সঙ্গে যোগ দেন হাজার হাজার গ্রামবাসী। এত তাড়াতাড়ি কী করে হল? এর
পিছনে ছিলেন এক মুক্তমনা ধর্মপ্রচারক, দয়ানন্দ সরস্বতী। ইনি মিরাটেরই মানুষ।
আর্যসমাজের ধর্মপ্রচারক বলে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতেন। দয়ানন্দ সূরজকুণ্ডে এলে
প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসাবে ধন সিং গিয়েছিলেন সৌজন্য সাক্ষাতে। তাঁর থেকেই ধন সিং
খবর পান ব্যারাকপুরে আর অন্যান্য জায়গায় সিপাই বিদ্রোহের পরিস্থিতি। সেখানেই দুজন
বানিয়ে ফেলেন রূপরেখা।
গুজ্জর ধন সিং কোতোয়ালই মিরাটের
বিদ্রোহের আসল নেতা। একে তো এলাকার মানুষ, তায় উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তা। আবার,
গুজ্জর জাতির আধিক্য বলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও বেশি। পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষ যোগ
দিতেই এই বিদ্রোহ গণবিদ্রোহে বদলে গেল। তখনও মিরাটের সেনারা বিদ্রোহ করেনি। দিনের
বেলায় পুলিশ-জনতার ভিড় সদর বাজারে হানা দিয়ে যে ক’জন ইংরেজ সেনা ছিল, তাদের
কোতোয়ালির ব্যারাকে বন্দী করলো। হানা দিল সেনাশিবির ক্যান্টনমেন্টে। ভারতীয় সেনারা
বিদ্রোহ করল, দখল হল ক্যন্টনমেন্ট। বিদ্রোহী সেনারা লং মার্চ করে দিল্লির দিকে
রওনা হলেন। এরাই শেষ পর্যন্ত বাহাদুর শাহ জাফরকে ফের লাল কেল্লায় ক্ষমতায় আনেন।
সেনারা দিল্লি রওনা হতেই রাত দুটো নাগাদ জনতা আর পুলিশের সম্মিলিত বাহিনী হানা দিল
মিরাট কারাগারে। বিদ্রোহে যোগ দিলেন কারাগারের রক্ষীরাও, মুক্তি পেলেন ৮৩৬ বন্দী,
তারাও যোগ দিলেন বিদ্রোহে।
আশা দেবীও শামলীরই বাসিন্দা,
লড়াকু মহিলা। আগেই পেয়েছিলেন বিদ্রোহের বার্তা। গুজ্জর মহিলাদের নিয়ে নিজের
নেতৃত্বে বানিয়েছিলেন এক বিরাট নারী বাহিনী। বাহিনীতে কেবল গুজ্জর নারীরাই ছিলেন
না, ছিলেন বাল্মিকী অর্থাৎ অচ্ছুৎ দলিত নারীরা। ছিলেন শিখ নারীরা। এমনকি
বৃহন্নলারাও।
সিপাই বিদ্রোহ দমনে বিরাট
বাহিনী নিয়ে ১১ মে এলেন ইংরেজ সেনানায়ক মিরাটের কমিশনার এফ উইলিয়ামস। তিনিই
বিষ্মিত! শুধু সিপাই আর গ্রামবাসীদের সঙ্গেই লড়তে হচ্ছে না, লড়াইয়ের ময়দানে জঙ্গলি
বেড়ালের মতো সশস্ত্র নারীবাহিনী আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি কামড়ে ধরছে ইংরেজ
সেনাদের। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে ইংরেজ সেনা, মরছে কাতারে কাতারে। পিছু হটতে হচ্ছে
উইলিয়ামসের বাহিনীকে। ১১ থেকে ১৩ মে, ইংরেজ বাহিনী বার বার পিছু হটতে বাধ্য হল,
পরাস্ত হল। এলাকার কর্তৃত্ব এল নারীবাহিনীর হাতে, কৃতিত্ব অবশ্যই আশা দেবী
গুজ্জরের।
পরদিন, ১৪ মে, বিশাল বাহিনী আর
উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপালো ইংরেজ। আশা দেবীর বাহিনীও সমানে লড়ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আশা দেবীরা বিজয়ী হননি। কিন্তু
যুদ্ধক্ষেত্রে দলিত নারীদের বীরত্বের কথা লেখেননি উচ্চবর্ণের প্রাধান্যের ভারতে।
লেখা নেই এই বীরাঙ্গনাদের কাহিনী। সেদিন ২৫৫ জন নারীর শহিদ হওয়ার নির্জলা তথ্যটা
আশা করি বাস্তবতার প্রমাণ।
অনেক চেষ্টা করেও আশা দেবীকে
জীবিত অবস্থায় ধরতে পারেনি ইংরেজ। আশা দেবীই ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম
বীরাঙ্গনা। পরাজয়ের গ্লানি মোচনের ক্ষোভে আশা দেবীর মৃতদেহটা ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল,
যেভাবে মৃত মঙ্গল পাণ্ডের দেহ ঝুলিয়ে রেখেছিল। আশা দেবীর দেহের পাশে ফাঁসি দেওয়া
হয়েছিল তাঁর সহযোদ্ধা বীরাঙ্গনা হাবিবা গুজ্জরী, রহিমা গুজ্জরী, রণবীরী বাল্মিকী,
শোভা দেবী বাল্মিকী, মহাবীরী দেবী, সহেজা বাল্মিকী, নাম কৌর, রাজ কৌর, দেবী
গুজ্জরী, ভগবানী দেবী, ইন্দর কৌর, কুশল দেবীদের। দেখো, রহিমা, হাবিবার পাশে ছিলেন
নাম, রাজ, ইন্দরের মতো শিখ মায়েরা, ছিলেন ভগবানী আর কুশলের মতো দলিত বৃহন্নলারা।
ধর্ম সেখানে বাধা হয়নি।
No comments:
Post a Comment