আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপ্তচর বিভাগের এক শীর্ষ নেতা সহ চারজনের রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৯৪৫-এর ১১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। বাকি তিন বিপ্লবী হলেন পবিত্র রায, জ্যোতিষচন্দ্র বসু ও অমর সিং গিল। চারজন একসঙ্গেই ধরা পড়েছিলেন। শীর্ষ নেতার স্ত্রীও আজাদ হিন্দ ফৌজের সক্রিয় কর্মী এবং মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ। তিনি চারজনেরই মৃত্যুদণ্ড রদের জন্য গান্ধীজিকে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানান। গান্ধীজি শুধু অনুরোধকারিণীর স্বামীর মৃত্যুদণ্ড রোধে চেষ্টা করবেন বলে জানান। অনুরোধকারিণী বাপুজিকে স্পষ্ট বলেন, “না। করলে সবার জন্য, না হলে নয়।”
১৯৪৫-এ বাপুজির মুখের উপর এমন কথা সরাসরি বলার জন্য আলাদা চারিত্রিক দৃঢ়তা
লাগতো। লাগতো সাহস এবং কঠোর সত্যনিষ্ঠা। সেই দৃঢ়তা ছিল বেলা মিত্রর, যাঁর স্বামী হরিদাস মিত্র ছিলেন
আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপ্তচর বিভাগের অন্যতম নেতা। বেলা মিত্রের সঙ্গে হরিদাস মিত্রের
বিয়ে হয় ১৯৩৬ সালে। তিনি ছিলেন নেতাজির সেজদা সুরেশচন্দ্র বসুর কনিষ্ঠ কন্যা। বেলা
বসু। ভাল নাম ছিল ওমিতা বসু। জন্ম ১৯২০ সালে
কোদালিয়ার বাড়িতে। পারিবারিক সূত্রে বিপ্লবী আন্দোলনে টান ছিলই। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪০ সালে ব্রিটিশের প্রতি আপোসকামী অবস্থানের জন্য রামগড়
কংগ্রেস অধিবেশন থেকে বেরিয়ে এসে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ‘আপোস-বিরোধী সম্মেলন’-এর
আয়োজন করেন। বেলা যোগ। সেখানে কাকার সঙ্গে ছিলেন বেলা, তাঁকে নারী বাহিনীর প্রধান
নিযুক্ত করেন সুভাষচন্দ্র।
এরপর নেতাজির মহানিষ্ক্রমণ, রাশিয়া জার্মানি হয়ে জাপানে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের
সর্বাধিনাযকের দায়িত্ব গ্রহণ। ভারতের দিকে পা বাড়াবার আগেই নেতাজি আজাদ হিন্দ
ফৌজের বিভি ছোট ছোট দলকে গোপনে ভারতে পাঠাচ্ছিলেন। লক্ষ্য ছিল, আজাদ হিন্দ বাহিনী
ভারতের মাটিতে পা দিলে দেশেও ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবেন এই দলগুলি।
তাঁদের নিরাপদে ভারতের উপকূলে অবতরণ করানো ও গোপন ডেরায় রেখে তাঁদের সঙ্গে
নিয়মিত যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল বেলার ওপর। বহু বাধা ও বিপদ সত্ত্বেও
উড়িষ্যার উপকূলে লোক পাঠিয়ে আজাদ হিন্দের গুপ্ত সেনাদের অবতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন
নেতাজির ঝাঁসির রাণি বাহিনীর সৈনিক বেলা মিত্র। ১৯৪৪ এর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর
পর্যন্ত কলকাতার এক গোপন স্থান থেকে সিঙ্গাপুরে ট্রান্সমিটারে সংবাদ আদানপ্রদান ও
নিরাপদে বিপ্লবীদের কাছে সেই বার্তা পেঁছে দিতেন হরিদাস ও বেলা মিত্র। হরিদাস
মিত্র গ্রেপ্তার হলে তিনি একাই সেই কাজের দায়িত্ব নেন। নিজের স্বর্ণালঙ্কার
বিক্রির টাকায় ফৌজের কর্মীদের নিরাপদে আনা ও থাকার ব্যবস্থা করেছেন।
স্বামী হরিদাস মিত্র ও অন্যান্যদের মৃত্যুদণ্ড রদের জন্য গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা
করতে সেই সময়ে বেলা মিত্র একাই পুনে গিয়েছিলেন। গান্ধীজি সকলের জন্য সচেষ্ট হতে
রাজি না হওয়ায় বেলা মিত্র ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু বেলা চলে আসার পর গান্ধীজি চিঠি
লিখেছিলেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলকে। গান্ধীজির চেষ্টাতেই রদ হয় সকলের ফাঁসি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হরিদাস মিত্র কিংগ্রেসের টিকিটে ভোটে জিতে বিধানসভাজ
ডেপুটি স্পিকার হন। কিন্তু বেলা মিত্র কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগ দেননি। তিনি আজাদ
হিন্দের ঝাঁসির রাণি বাহিনীর নামকে ধরে রেখে ‘ঝাঁসির রানী সেবাদল’ গঠন করেন। এই
সেবাদলের মূল কাজ ছিল পূর্ববঙ্গ থেকে আগত অগণিত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সাহায্য
করা। এছাড়াও নানা উন্নয়মূলক কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। বালি এবং ডানকুনির মাঝে
রাজচন্দ্রপুরের কাছে অভযনগরে তিনি উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসন দেওয়ার জন্য শিবির তৈরি
করে। তাঁদের স্বার্থে নিজেও সেখানেই থাকতে শুরু করেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে বেলা
মিত্রের স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। কঠিন অসুখে শরীর খারাপ হয়ে যায়। অবশেষে ১৯৫২ সালের
জুলাই মাসে এই মহিয়সী নারীর জীবনাবসান হয়। তাঁর পুত্র অমিত মিত্র এখন পশ্চিমবঙ্গে
অর্থমন্ত্রী।
বেলা মিত্র পর্দার আড়ালে থেকেই কাজ করে গেছেন আজীবন। বেলা মিত্রকে সম্মান জানাতে ভারতীয় রেল হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইনে তাঁর স্থাপিত অভয়নগর উদ্বাস্তু কলোনির নিকটবর্তী স্থানে একটি রেল স্টেশন স্থাপন করেন। স্টেশনটির নাম রাখা হয় ‘বেলানগর’। ১৯৫৮ সালের ২৩ নভেম্বর এই স্টেশনটির উদ্বোধন করেন ভারতীয রেলের উপমন্ত্রী তথা আজাদ হিন্দ বাহিনীতে বেলার সহযোদ্ধা শাহনওয়াজ খান। ভারতের রেলের ইতিহাসে বেলানগরই প্রথম রেল স্টেশন, যার নামকরণ হয়েছিল কোনও মহিলার নামে।
No comments:
Post a Comment