সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : রবিকবির ১৫৯তম জন্মদিন।লক ডাউনের মধ্যে হবে না পাড়ায় পাড়ায় বাঙালির রবীন্দ্র বন্দনা।শুনেছিলাম ঈশ্বর খুঁজতে তীর্থ পরিক্রমায় যাওয়ার প্রয়োজন হয় না।ভক্তি থাকলে ঘরে বসেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।এবার বাঙালির বোধ,চেতনা,সাংস্কৃতিক উত্তরণের ঈশ্বর সদৃশ নমস্য রবীন্দ্রনাথকে এবার মানুষ বাড়িতে বসে স্মরণ করবেন নিজের নিজের মতো করে।আমিও স্মরণ করতে চাই এক নতুন আঙ্গিকে।অনেকের মনেই প্রশ্ন ,তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের মানুষ।প্রকৃতি ও পরম ব্রহ্মের উপাসক।প্রচুর কবিতা লিখেছেন সেই নিরাকার ঈশ্বরকে স্মরণ করে।প্রচুর গান লিখেছেন পূজা পর্যায়ে। আবার তিনি শেষ বয়সে লিখলেন ছোট গল্প রবিবার (আশ্বিন ১৩৪৬)। গল্পের নায়ক অভীক।নায়িকা বিভা।বিভা ব্রাহ্মধর্মের কন্যা। অভীক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশের সন্তান।রক্ষণশীল সমাজেরই প্রেম নিষিদ্ধ।দুজনের একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ ঘটতে পারে ছুটির দিন রবিবারে।কিন্তু সেদিন বিভার উপাসনা গৃহে যাওয়ার দিন।ফলে অভীক বোঝে ধর্মই মানুষকে মানুষের সঙ্গে মিলতে দেয় না।অভীক হিন্দু কট্টর বংশের সন্তান ।কিন্তু নাস্তিক।অভীক তাঁর মাকে বলে ,মা,দেবতাকে অনেককাল ছেড়েছি,এমন অবস্থায় আমাকে দেবতার ছাড়াটা নেহাত বাহুল্য।,,,,রবীন্দ্রনাথ অভী কেরমুখ দিয়ে বলেছেন,ধর্ম মোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো।তোমরা ভারতবর্ষের ঐক্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখ।কিন্তু যে দেশে দিনরাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি সে দেশে সব ধর্মকে মেলাবার পুন্তব্রত আমার মতো নাস্তিকের ই।আমিই ভারতবর্ষের ত্রাণকর্তা।
পরের বছর তিনি লেখেন ল্যাবরেটরি(আশ্বিন ১৩৪৭)।সেই গল্পের অধ্যাপক চরিত্র নিজেকে নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে বেদনাহত হয়ে ৬৬বছর বয়সে লেখেন,ধর্মের বেশে মোহ এসে যা রে ধরে, অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো।একটা কথা বুঝতে হবে এখানে বিধাতা বা ধর্ম বলতে তিনি জীবন দেবতা ও মানব ধর্মের কথা বলেছেন।
এই কবিতা লেখার কিছুদিন আগে ৮বৈশাখ ১৩৩৩শান্তিনিকেতনে এক ভাষণে বলেন,"....এই মোহ মুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো।,,,,,,,,,,,,রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ ।রবীন্দ্রনাথ চতুরঙ্গ উপন্যাসে নাস্তিক চরিত্র জগমোহন(জ্যাঠামশাই) এর মুখ দিয়ে বলেছেন,দেখো বাবা, আমরা নাস্তিক,সেই গুমরেই আমাদিগকে একেবারে নিষ্কলঙ্ক নির্মল হইতে হইবে।আমরা কিছু মানি না বলিয়াই আমাদের নিজেকে মানিবার জোর বেশি। ব্রাহ্ম ধর্মে সারা জীবন আস্থা রেখে চলেছেন।বার্ধক্যে এসে তাঁর উপলব্ধি অহেতুক।তাই ৭১,বছর বয়সে হেমন্ত বালা দেবীকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট ভাবে লেখেন"ধর্মমত আমার আছে কিন্তু কোনো সম্প্রদায় আমার নেই।আমি নিজেকে ব্রাহ্ম বলে গণ্য ই করি না।,,,,আমি ধর্ম সমাজের রকম পরা ছাপা মারাদের মধ্যে কেউ নেই নইরাজার দত্ত উপাধি আমি ত্যাগ করেছি,সম্প্রদায়ের দত্ত উপাধিও আমার নেই।(৮নভেম্ভর,১৯৩২)
তাই প্রশ্ন ওঠে রবীন্দ্রনাথ কি শেষ বয়সে নাস্তিক হন?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা দরকার নাস্তিক কাহারে কয়?
নাস্তিক শব্দটি হালফিলের নয়। এই শব্দটি মৈত্রয়নী উপনিষদের সমকালীন।ভারতীয় সনাতন বৈদিক ধর্ম নাস্তিক শব্দের অর্থ , যাঁরা বেদে অবিশ্বাসী। আবার পাণিনি বলেছেন , সে নাস্তিক যে পরলোক মানে না। নাস্তিক সম্পর্কে ধর্মীয়বেদ্দারা বহুদিন থেকে চিন্তিত। অগ্নি পুরাণের ষোড়শ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, প্রাচীনকালে দেবতা অসুরের যুদ্ধে দেবতারা পরাজিত হলে দেবতারা শ্রীবিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণু বুদ্ধদেব হয়ে জন্ম নেন পৃথিবীতে। বেদ বিরোধী তত্ত্ব প্রচার করেন বুদ্ধ দেব। ফলে অসুরেরা নরকগামী হন।অসুরেরা বিনাশ হয়। অনেকে বলেন, ধর্মের দেশ ভারত। কিন্তু তাঁরা জানেন কি এই ভারতে চার্বাক গোষ্ঠী ,আজিবিকাশ ,কেশকম্বলিন, পুকূথ কাত্যায়ন,প্রমুখ বিশিষ্ট নেতৃত্ব বেদ ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। যার ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতে আসেন বুদ্ধদেব, মহাবীর। নাস্তিক তাঁরাই, যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, বর্ণবিভাজনের বিরোধিতা করেন। তাই সব ধর্মেই নাস্তিকদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আছে।
আধুনিক যুগে নাস্তিকতাকে সাইকোপ্যাথও বলা হচ্ছে। বলছেন ধর্মীয় নেতারা। রবীন্দ্রনাথ নাস্তিক ছিলেন না।তিনি পরজন্মে বিশ্বাস করে প্ল্যানচেট করতেন। তবে তা ছোটবেলায় ও মধ্য বয়সে।সে জন্য রবীন্দ্রনাথ কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন এমন সিদ্ধান্তেও আসা যায় না।কেননা তিনিই পরে স্বীকার করেন ভূতের বিশ্বাস পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যেই নুন্যাধিক পরিমাণে আছে ,যখন বলা যায় আমি এই ভূতের বিশ্বাসের কুসংস্কার কাটাইয়াছি তখন এমন কথা বলা হয় না যে আমি মনুষ্যত্বের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করিয়াছি।(হিন্দু ব্রা হ্ম তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা,জৈষ্ঠ্য ১৩১৯)। গঙ্গায় স্নান কি পুণ্য অর্জনের সহায়ক?এই প্রশ্নে তাঁর জবাব_ "কোনো একটি বিশেষ নদীর জলে স্নান করলে নিজের অথবা ত্রি কোটি সংখ্যক পূর্বপুরুষের পারলৌকিক সদগতি ঘটার সম্ভাবনা আছে এ বিশ্বাসকে আমি সমূলক বলে মেনে নিতে রাজি নই এবং এ বিশ্বাসকে আমি বড়ো জিনিস বলে শ্রদ্ধা করি নে।" (তপোবন,শান্তিনিকেতনে,অগ্রহায়ণ,১৩১৬).জ্যোতিষচর্চার বিরুদ্ধে ও তাঁর গল্প চোরাই ধন । তাই প্রমাণ করে। আবার নিকটজনের আবদারে কয়েক জন জ্যোতিষীকে হাতও দেখিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এক বিশাল ব্যক্তিত্ব। যার পূর্ণ বিশ্লেষণ ছোট্ট পরিসরে সম্ভব নয়। তাঁর মানবতার ধর্ম মানব সমাজে চিরকালীন হয়ে থাকবে।
No comments:
Post a Comment