ঠাকুরবাড়ির পদবী রহস্য - Songoti

ঠাকুরবাড়ির পদবী রহস্য

Share This

সুজিৎ  চট্টোপাধ্যায় : ৮মে ২০২০। বাংলায় ২৫বৈশাখ ,১৪২৭ । বিশ্ববন্দিত বঙ্গসন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৯ তম জন্মদিন। প্রতিবারের মত বাঙালি নতুন উৎসাহে রবিকবির বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে হাজারও বাকচর্চা করবেন। এই প্রতিবেদকের সেই  সাহস নেই যে রবীন্দ্র চর্চা করবে। বরং চলুন ইতিহাস ঘেঁটে দেখি ঠাকুর পরিবারের পদবী রহস্য। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন  বন্দ্যোপাধ্যায়।তারপর ঘটনাচক্রে পদবী পাল্টে হলো কুশারী। তারপর ঠাকুর। এই পদবী পরিবর্তনের পেছনে যেমন একটা ইতিহাস আছে , তেমন আছে বাংলার   সমাজ চিত্র। কি সেই ইতিহাস?
বাংলায় পদবীর ইতিহাসখুব একটা পুরনো দিনের ঘটনা নয়। মধ্য যুগের সামন্তবাদী সমাজের প্রতিক্রিয়া আর ব্রিটিশ শাসনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফসল পদবী।মূলত যা গড়ে ওঠে বৃত্তি নির্ভর। বাঙালি মুসলিমদের পদবী প্রসঙ্গ আলোচনায় আনছি না, কারণ বিষয়, ঠাকুরবাড়ির পদবী।


ইতিহাস বলছে, অনুমান ৮ ম/১০ শতকে শান্ডিল্য গোত্রীয়  ব্রাহ্মণ ক্ষিতীশ কনৌজ থেকে গৌড়রাজ বৈদ্যবংশীয় আদিশুরের পূত্রেষ্ঠি যজ্ঞে পৌরহিত্য করে যখন ফিরে যান, কনৌজ এর রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় তাদের ত্যাগ করলেন। কারণ? হিন্দু বর্ণ বিভাজনের  রোষে পড়তে হয় তাঁদের। বঙ্গ যে মেলেচ্ছস্থান।এখানে   পতিত মানুষদের বসবাস। কোনও উচ্চ বর্ণের মানুষ এখানে থাকত না। তাইতো কনৌজ থেকে পুরোহিত নিয়ে যেতে হয়। বাধ্য হয়ে সেই পুরোহিতরা আবার বাংলায় ফিরে আসেন। অনেকে বলেন আদিশুর নয়, বাংলায় যজ্ঞের প্রয়োজনে পুরোহিত নিয়ে আসেন বাংলার রাজা গোপাল। মোট কথা, পুরোহিত বাংলায় আমদানি হয় উত্তরপ্রদেশ থেকে। আসেন পাঁচজন পুরোহিত যাঁরা ছিলেন পাঁচ গোত্রের। আসেন মেধা তিথি, ক্ষীতিশ,  বীত রাগ,সৌভোরি এবং সুধানি ধি।।এদের সহকারী হিসেবে দাসরথি (বোস),মকরন্দ (ঘোষ),বিরাট (গুহ), কালিদাস (মিত্র) আসেন বাংলায়। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ ছিলেন শান্ডিল্য গোত্রের  । বাসস্থান ছিল  রাঢ়
বাংলার বীরভূমের বন্দ্যঘটি গ্রামে। পেশা অধ্যাপনা।সেযুগে এঁদের বলা হত উপাধ্যায়। ক্ষিতীশের পুত্র  ভট্টনারায়ণ জীবিকার প্রয়োজনে চলে আসেন হুগলিতে। এঁর লেখা ছিল বেশ কয়েকটি গ্রন্থ। যেমন মুক্তি বিচার ,প্রয়োগরত্ন, বেণীসং হার । ভট্টনারায়ণের পুত্র দীননাথ চলে আসেন বর্ধমানের কুশ গ্রামে ।
 গাঁঈ পদবী হয় কুশারী। এই বংশের একটি শাখা ১৬শ শতকে সুন্দরবন অঞ্চলের যশোরের (এখন বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলায় রূপসা থানার অন্তর্গত)পিঠাভোগ গ্রামে বসতি করেন জগন্নাথ।তিনি প্রেম করে বিয়ে করেন পিরালি  ব্রাহ্মণ যশোরের চেং গুটিয়া পরগণার দক্ষিণডিহি (এখন খুলনার ফুলতলী থানার) গ্রামের শুকদেব রায়  চৌধুরীর কন্যাকে।পতিত ব্রা হ্মণ পরিবারে বিয়ের জন্য স্বজন ও সমাজ পরিত্যাজ্য হলেন জগন্নাথ। তিনি চলে আসেন যশোরের   মণিরামপুর থানার উত্তরপাড়ায় । ইতিহাস বলছে,জগন্নাথের মধ্যম পুত্র পুরুষোত্তম যিনি বিদ্যাআগম বাগীশ নামে পরিচিত ছিলেন।তিনিও এক মুসলিম কন্যাকে বিয়ে করেন। ফলে তিনিও সমাজচ্যুত হন। পরবর্তী বংশধর পারিবারিক গোলযোগের কারণে কলকাতায় চলে আসেন।

রবীন্দ্র গবেষক প্রভাত মুখোপাধ্যায় তাঁর রবীন্দ্র জীবনী ১ ম খণ্ডের তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখেছেন,,,,,,, জাতি কলহে বিরক্ত হইয়া মহেশ্বর ও শুকদেব নিজ গ্রাম বারো পাড়া হইতে কলিকাতা গ্রামে র দক্ষিণে গোবিন্দপুরে আসিয়া বাস করেন। সে সময়ে কলকাতা ও সুতানুটি তে শেঠ বসাকরা বিখ্যাত বণিক। এই সময়ে ইংরেজদের বানিজ্য তরণী গোবিন্দপুরের গঙ্গায় আসিয়া দাঁড়াইত।রবীন্দ্রনাথের  পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী ইংরেজ ক্যাপ্তেনদের এই সব জাহাজে মালপত্র উঠানো নামানো ও খাদ্য পানীয় সংগ্রহাদি কর্মে প্রবৃত্ত হন। এই সকল শ্রম সাধ্য কর্মে  স্থানীয় হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা তাঁহার সহায় ছিল।,,,,,,তাহারা পঞ্চাননকে ঠাকুর মশায় বলিয়া সম্বোধন করিত। কালে কালে জাহাজের কাপ্তেনদের  কাছে ইনি পঞ্চানন ঠাকুর নামেই চলিত হইতেন, তাহাদের কাগজপত্রে তাহারা tagore, tagoure লিখিতে আরম্ভ করল।এই ভাবেই কুশারী পদবীর পরিবর্তে ঠাকুর পদবী চালু হইল।
বিখ্যাত অভিধান রচয়িতা ও ভাষাবিদ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন , ঠাকুর শব্দটি এসেছে তুর্কি শব্দ তাগরি থেকে। তৎসম সংস্কৃত শব্দ ঠককুর। তা থেকে ঠাকুর। ঠাকুর শব্দের অর্থ স্বামী,মনিব,মালিক,ঈশ্বর ।স্বাভাবিকভাবেই ঈশ্বরের পরবর্তী দাবিদার ব্রাহ্মণ।আবার বৈষ্ণবদের গুরুকেও 
ঠাকুর বলা হয়। যেমন হরিদাস ঠাকুর। আবার বাংলায় পাচকদেরও ঠাকুর বলা হয়। ক্ষৌরকার দেরও নাপিত ঠাকুর বলা হয়।
পঞ্চানন কুশারীর পুত্র জয়রাম ইংরেজের জমি মাপকের কাজ করে ভালো পয়সা উপার্জন করেন। তাঁর পুত্র। নীলমণি চট্টগ্রাম ও ওড়িশার নিমকমহলে সেরে স্তারি করে আরও অর্থ রোজগার করেন। সেজ ভাই দর্পনারায়ণের সাথে একত্রে ছিলেন১৭৬৫সাল থেকে।১৭৮৪তে মনোমালিন্য।  নীলমণি সেকালের সুতানুটি গ্রামের জোড়াসাঁকোর মেছুয়া বাজারে চলে যান।১৭৮৪তে চিৎপুরের ধনী ব্যবসায়ী বৈষ্ণব চরণ শেঠের দেওয়া এক কাঠা জমির ওপর গোলপাতার বাড়ি তৈরি করেন। নীলমনি  পুত্র  রামলোচন জমিদারি কেনেন প্রথম । তাঁর ছিল না কোনও সন্তান। তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামমণি ও তাঁর দক্ষিণডিহির রামচন্দ্র রায়চৌধুরীর কন্যা মেনকাদেবীর কনিষ্ঠ সন্তান দ্বারকানাথকে দত্তক নেন। এই দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ। তাঁর ১৪তম ও কনিষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথ। সুতরাং কেউ যদি রবীন্দ্রনাথকে  রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বা রবীন্দ্রনাথ কুশারী বলেন, ভুল হবে না  মোটেই।

No comments:

Post a Comment