বিজ্ঞাপনে মডেল হতে রবীন্দ্রনাথ কি শর্ত দিতেন? - Songoti

বিজ্ঞাপনে মডেল হতে রবীন্দ্রনাথ কি শর্ত দিতেন?

Share This
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা: বিজ্ঞাপন আধুনিক জীবনযাত্রার একটি সহযোগী বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। জীবনের সবক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপনের রমরমা। চীনের ইনান প্রদেশে খৃষ্টপূর্ব ৭০০ সালে প্রথম বিজ্ঞাপন পরিকল্পিত উপায়ে শুরু  হয় নিও ফ্যামিলি নিডল শপের বিজ্ঞাপন। মিশরে অবশ্য পণ্যের তথ্য ও গুনাগুণ প্রচারিত হতো প্যাপিরাস কাগ জে। রোমান নগর পম্পেইতেও পণ্যের প্রচার হতো।


বাংলায় ১৭৭৮সালে ক্যালকাটা ক্রনিকল ইংরেজি কাগজে প্রথম পঞ্চানন কর্মকারের একটি বাংলা ব্যাকরণের বইএর বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। বাংলা পত্রিকায় পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন প্রথম ছাপা হয় ১৮৪০ সালে।পত্রিকার নাম সংবাদ প্রভাকর। ১৮৬০ সালে রংপুর দিকপ্রকাশ পত্রিকায় পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত । ধীরে ধীরে বিজ্ঞাপনে আসতে শুরু করলো বহু পণ্য। লক্ষ্মী বিলাস তেলের বিজ্ঞাপনে বলা হতো মাথা ব্যথা, হাত পা জ্বালা উপশমে সেরা তেল। এমন অনেক বিজ্ঞাপনে যা দাবি করা হত তার গ্যারান্টি দেওয়া হত না।অর্থাৎ প্রথম যুগে থেকেই বিজ্ঞাপনে অসাধু রীতি প্রয়োগ হত। আজও সেই ট্র্যাডিশন চলছে। কোনও বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে এ স্বাদের ভাগ হবে না। অর্থাৎ শেখানো হচ্ছে ভালো জিনিস একাই খেতে হয়। ভাগ করে খেতে নেই। ২৬বছরের যুবক বৈভব বেদি আদালতে একটি মামলা করেন। তিনি ৭বছর ধরে বিজ্ঞাপিত ব্র্যান্ডের বডি স্প্রে ব্যবহার করছেন।বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছিল যে এই স্প্রে ব্যবহার করবে তাদের দিকে দল বেঁধে মেয়েরা ছুটে আসবে। কিন্তু অভিযোগকারীর বক্তব্য,bআজ পর্যন্ত একটি মেয়েও তাঁর দিকে এগিয়ে আসেননি। ভারতে একটি স্বাস্থ্যবর্ধক পানীয়র বিজ্ঞাপনে বলা হয়, স্ট্রংগার, টলার, শারপার। ব্রিটেনে
২০০৮ সাল থেকেই এই বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। ডেনমার্কে নিষিদ্ধ ২০০৪সাল থেকে।বাংলাদেশে বলা হয় ২ গ্লাস এই পানীয় খেলে ৬৬৬গ্রাম ইলিশ মাছের     আয়রনের সমান আয়রন মেলে।কলকাতার এক দাদা আর এক পানীয়র বিজ্ঞাপনে জানিয়েছেন, ডিমে আছে অর্ধেক প্রোটিন। পানীয়তে আছে ডবল। অর্থাৎ চার টাকার একটা ডিম খাওয়ার   চেয়ে দু চামচ হেলথ ড্রিঙ্ক গুলে খাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। তবে কি ইতিবাচক বিজ্ঞাপন নেই? আছে তবে তা কোটিতে গুটিক। সম্প্রতি লাইফবয় লিকউইট সোপের বিজ্ঞাপনে বলছে হাত ধোন।যেকোনো ব্র্যান্ডের সোপ দিয়ে।


এহেন বিজ্ঞাপনের জগতে যদি বাঙালির আইকন রবীন্দ্রনাথকে মডেল হিসেবে পাই সে কাহিনী জানার আগ্রহ কার না হবে। হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু পণ্যের বিজ্ঞাপন করেছেন টাকার বিনিময়ে।তবে তাঁর এক শর্ত ছিল।বিজ্ঞাপনের কপি রাইটের দায়িত্ব তাকেই দিতে হবে। সেই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ নামটাই যথেষ্ট।ভসুতরাং কেইবা আপত্তি করবে?

বিখ্যাত পরিচালক নীতিন বোস,ক্রিকেটার কার্তিক বোস, রেকর্ডিস্ট মুকুল বোস দের পূর্বপুরুষ ছিলেন হেমেন বোস।bকলকাতার আমহস্ট স্ট্রীটের বনেদি বাড়ির ছিল প্রসাধনী ব্যবসা। ছিল কুন্তলীন কেশ তেল, স্নো।বিজ্ঞাপনে ব্যবহার হত রবীন্দ্রনাথের ছবি। রবীন্দ্রনাথ কপি লিখেছিলেন, কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে নতুন কেশ হইয়াছে। এই বিজ্ঞাপনে হয়ত টাকা পয়সা কিছু কম নিয়েছিলেন,রবীন্দ্রনাথ।কেননা দুটি পরিবারই ছিল ব্রাক্ষ। সেসময় একটি কবিতা ও লেখেন রবি কবি। কেশে মাখো কুন্ত লীন, রুমালেতে দিলখোস, পানে খাও তাম্বু লীন , ধন্য হোক এইচ বোস।  আর একটি প্রসাধনী সংস্থা ছিল রেডিয়ম ল্যাবরেটরি।তাদের ছিল স্নো,ক্রিম, কেশ তেল, লাইম জুস, তিল তিল ও গ্লিসারিন। এদের ক্রিম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কপি লিখেছিলেন, রূপচর্চার জন্য স্নো ও ক্রিম জাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার করেন, তারা রে ডিয়ম ফ্যাক্টরির তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না ।এছাড়াও ঘি ,লেখার কালি,এমনকি হারমোনিয়ামের বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল।দেশজ কোম্পানির কালি ছিল সুলেখা। যাদের বাজারে বিদেশি কোম্পানি পার্কার ও শেফার্সের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো। রবীন্দ্রনাথ সুলেখা কালির পক্ষে লিখেছিলেন,সুলেখা কালি।এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো। সুলেখা নামটিও তাঁর দেওয়া। আর একটি স্বদেশী কালি কোম্পানি কাজল কালি র বিজ্ঞাপনেও কপি লেখেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লেখেন,কাজল কালি ব্যবহার করে সন্তোষ লাভ করেছি। এর কালিমা বিদেশি কালির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।আমরা ছেলেবেলায় জলযোগ মিষ্টির দোকানে দেখেছি তারা বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য ব্যবহার করতেন। রবিকবি লেখেন, জলযোগের বানানো মিষ্টান্ন আমি চেখে দেখেছি।এর আলাদা স্বাদ আছে।

দেশের পূর্ব রেলের বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথের হঠাৎ দেখা কবিতার দু লাইন ব্যবহার করা হয়েছিল।এয়ারলাইনসের বিজ্ঞাপনেও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কে এল এম রয়াল ডাচ এয়ারলাইনসের বিজ্ঞাপনে তাঁর লেখা কপি বিশ্বভারতীর পত্রিকায় আছে। স্বদেশী ঘরদোর রঙের কোম্পানি নেপিয়ার পেইন্ট ওয়ার্কস এর বিজ্ঞাপনও করেছেন রবিকবি। দ্বারিকের মিষ্টিও বিখ্যাত। সেই বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছিলেন,বাসনার সেরা বাসা রসনায়। দেশীয় সাবান নির্মাতা গডরেজের সাবানের ও বিজ্ঞাপন করেন রবীন্দ্রনাথ। লেখেন,এই সাবানের অপেক্ষা ভালো কোনো সাবান আমার জানা নাই। আমি ভবিষ্যতে শুধু এই সাবানই ব্যবহার করিব স্থির করিয়াছি। কো অপারেটিভ ইন্সুরেন্স সোসাইটি লিমিটেডের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, লক্ষ্মীর অন্তরের কথাটি হচ্ছে কল্যাণ , সেই কল্যাণের দ্বারা ধন  শ্রীলাভ করে। কুবেরের অন্তরের কথাটি হচ্ছে সংগ্রহ , সেই সংগ্রহের দ্বারা ধন বহুল ত্ব লাভ করে।
দেশজ সংস্থাকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি ব্রিটিশ কোম্পানির হয়েও তিনি বিজ্ঞাপন করেন। বাজারে ভারতীয়দের তখন  চা খাওয়ানো শেখাচ্ছে ইংরেজ।লিপটন কোম্পানি বিজ্ঞাপনের কপি লিখতে রবি কবির শরণাপন্ন হলেন।সেযুগে অফিসকে বলতো আফিস। তেমন কেটলিকে বলত কাতলি ।রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,চা স্পৃহ চঞ্চল, চাতক দল চল, কাতলি জল তল কল কল হে.....।
ব্রিটিশ কোম্পানি ক্যাডবেরির বর্ণভিটারও বিজ্ঞাপন লেখেন রবীন্দ্রনাথ। লেখেন,বর্নভিটা  সেবনে উপকার পাইয়াছি।
প্রসঙ্গ শেষ করবো দুটি মজার তথ্য জানিয়ে । একবার ভারত ব্লেড সংস্থা কবির কাছে আসেন বিজ্ঞাপনে মডেল হতে ও  কপি লেখার জন্য।রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে নিজের দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,এই দাড়ি নিয়ে যদি আমি তোমাদের ব্লেডের বিজ্ঞাপন করি তাহলে কি কেউ কি তোমাদের ব্লেডের  ধারে আস্থা রাখবে? না আমাকে করবে বিশ্বাস?
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও মজার।কলকাতায় এক বাঙালি কোম্পানি ছিল এস সি রায় অ্যান্ড কোম্পানি। ১৬৭/৩ কর্ণ ওয়ালিশ স্ট্রীটে আজকের বিধান সরণিতে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে তৈরি করত পাগলের ওষুধ। মালিক ছিলেন ডাক্তার উমেশ চন্দ্র রায়। পাগলের মহা ঔষধ শিরোনামে এই বিজ্ঞাপনে কবি লিখলেন, ৭০বছরের ঊর্ধ্ব কাল যাবৎ লক্ষ লক্ষ দুর্দান্ত পাগল ও সর্বপ্রকার বায়ুগ্রস্থ রোগীর আরোগ্য করিয়াছে। মূর্ছা,মৃগী,অনিদ্রা,হিস্টিরিয়া, অক্ষুধা , স্নায়বিক দুর্বলতা প্রভৃতি রোগেও ইহা আশু ফল প্রদ।।
এরপর কবি লিখলেন, আমি ইহার উপকারিতা বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।এই বিজ্ঞাপন কলকাতার বিখ্যাত সাময়িকী সহ সব দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তবে সে যুগে রবীন্দ্রনাথ একা নন বিজ্ঞাপনের বাজারে আচার্য্ প্রফুল্লচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্রের ও  চাহিদা ছিল প্রবল।

No comments:

Post a Comment