মানবিকতা | ডঃ সুকান্ত কর্মকার | সাহিত্যগ্রাফি - Songoti

মানবিকতা | ডঃ সুকান্ত কর্মকার | সাহিত্যগ্রাফি

Share This

শহরজুড়ে কদিন থেকেই কার্ফু জারি হয়েছে। এবারের দাঙ্গা ভয়ানক আকার নিয়েছে। শহরে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। এখন ছোটোখাটো ব্যাপারেই পরস্পরে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে। অথচ আগে কি সুন্দর সহাবস্থান ছিল ! একটা সৌভ্রাত্ব-সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধা ছিল একে অপরে। ধীরে ধীরে একটা অসহিষ্ণুতা-অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। মানবিক বন্ধনটা কোথায় যেন ছিঁড়ে গেছে। শহরের সব দোকান-পাট বন্ধ। রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে। চারিদিক শুনশান। মোড়ে-মোড়ে পুলিশি টহল চলছে, কোন ঝামেলা দেখলেই গুলি চালানোর
নির্দেশ আছে।
       এই রকম এক সময়ে ভোর থেকেই রুক্সিণীর প্রসব বেদনা উঠেছে। যত বেলা বেড়ে সূর্য মধ্য গগনের দিকে এগোচ্ছে ততই যন্ত্রণা তীব্র হচ্ছে। হাসপাতালে এক্ষুনি নিয়ে যাওয়া জরুরী। রুক্সিণীর স্বামী অসহায়ের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি খুঁজতে থাকে। দু-একটা গাড়ি যাওবা আসছিল, হাসপাতালে যেতে কেউ রাজী হচ্ছিল না। হঠাৎ উদয় হলো এক অটো। অটোচালক রুক্সিণীর প্রতিবেশী, রহমান।  মুখে দাড়ি আর মাথায় ফেজ টুপি দেখে চিনতে আসুবিধা হয় না যে, ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। এই রকম অবস্থায় সকলে যখন ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন সে খবর পেয়ে  নিজে থেকে এগিয়ে এসেছে এক প্রসূতি মায়ের বিপদের দিনে।  রুক্সিণীর স্বামী হিন্দু হয়ে সেই অটোতে চাপতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ! কিন্তু সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই মনে সায় না থাকলেও বাধ্য হয়েই অটোয় চেপে হাসপাতাল যেতে রাজী হয়।
       অটোচালক নিজেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে রুক্সিণীকে ধরে অটোতে বসায়। তারপর কার্ফুর তোয়াক্কা না করে ছুটে চলে হাসপাতালের দিকে। রুক্সিণীর স্বামী জানতো রহমান দুই সন্তানের পিতা। রুক্সিণীর স্বামীর মনে একটা ভয় কাজ করছিল যদি মুসলিম অটোচালকের অটোয় চেপে সে কারুর কুনজরে পড়ে। অটোর মধ্যে রুক্সিণী তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বন্দুক হাতে পুলিশের তীক্ষ্ণ নজর অটোর দিকে।
       হাসপাতালে পৌঁছে রুক্সিণী ভর্তি হলো প্রসূতি বিভাগে। যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাই রুক্সিণীর স্বামীর কথায় রহমান থেকে যায় হাসপাতালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুকান্না জানান দিল এক কন্যা শিশুর আগমন ঘটেছে এই পৃথিবীতে। রুক্সিণীর চোখে-মুখে তখন মাতৃত্বের পূর্ণতার হাসি। হাসপাতালে পৌঁছোনোর ইতিবৃত্ত জেনে ডাক্তার থেকে নার্স -- সবার মুখেই রহমানের স্তুতি। রুক্সিণীর স্বামীর সঙ্গে অপেক্ষারত রহমানের মুখেও এক তৃপ্তির হাসি। ঠিক যেন দাঙ্গা বিধ্বস্ত শহরের ক্যানভাসে এক মানবিক মুখের ছবি আবার শান্তির বার্তা বয়ে এনেছে......
       হাসপাতালের লোকজন সেদিন সদ্যজাত কন্যাশিশুর নাম রাখলো "সম্প্রীতি"।

No comments:

Post a Comment