মহাভারতের গল্পকে পুনর্নিমাণ করে মঞ্চায়িত দ্য ফর্মলেস কিং - Songoti

মহাভারতের গল্পকে পুনর্নিমাণ করে মঞ্চায়িত দ্য ফর্মলেস কিং

Share This

বার্তা প্রতিবেদন, কলকাতাঃ রাজা : দ্য ফর্মলেস কিং এর উপস্থাপনা প্রখ্যাত কথাকলি নৃত্যশিল্পী কলামন্ডলম গৌতমের স্বপ্ন,  ১২ই জানুয়ারি, ২০২০, সন্ধ্যা ছটায় সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট এর ওপেন এয়ার থিয়েটারে অবশেষে বাস্তবের রূপ পেল এতদিনের সাধনা ও পরিকল্পনা, সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সহায়তায়।
কলামন্ডলম গৌতম এর আকস্মিক প্রয়াণে, তাঁর পরিচালিত বেহালা নাট্যলোকের ছাত্র- ছাত্রীরা সিদ্ধান্ত নেয় এই অসম্পূর্ণ কাজটিকে শেষ করে মঞ্চায়িত করার। সৃজনশীলতার মাধ্যমে তাঁদের গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করাই ছিল তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য।সমস্ত আয়োজন ও পরিবেশনার গুরুভার ছিল খুব কাছের ছাত্র দিবেন্দু তরফদার এর। বহু অভিজ্ঞ শিল্পী ও নৃত্যগুরুরা এগিয়ে এসেছিলেন ওদের প্রয়াসটিকে সফল করে তুলতে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ থেকে মহাপ্রস্থান : এই সময়কালকে কেন্দ্র করে দ্রৌপদীর স্বর ও সত্তার যে যাত্রা, তার অস্তিত্বের যে তীব্র লড়াই, সেই বয়ানের প্রেক্ষিতে মহাভারতের গল্পকে পুনর্নিমাণ করে অভিঘাত সৃষ্টি করে রাজা : দ্য ফর্মলেস কিং ।
বিখ্যাত অভিনেতা কবির বেদীর জলদগম্ভীর গলার স্বর ও দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গীত নির্দেশনা এই পরিবেশনাটিকে এক অন্য মাত্রা প্রদান করেছে। বিশিষ্ট আলোকশিল্পী শ্রী দিনেশ পোদ্দারের আলো তৈরী করেছিল এক স্বপ্নীল মঞ্চমায়া যা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

জয়দীপ সিনহার গায়কী মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল উপস্থিত শ্রোতাদের। এছাড়াও বিশেষ সংযোজন ছিল কলামন্ডলম গোপাকুমার এর চেন্ডা, শ্রী শংকর নারায়ণ স্বামীর মৃদঙ্গম ও রূপসা নাগের গায়নশৈলী যা দক্ষ নৈপুন্যে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল আবহ সঙ্গীত কে।

এই প্রযোজনায় অভিনয় এবং নৃত্য পরিবেশনা করেছেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিরা-
দ্রৌপদীর অন্তরাত্মা যুবতি হিসেবে অভিনেত্রী একাবলি খান্না অনবদ্য। কথাকলি শিল্পী কলামন্ডলম সূচীন্দ্রনাথান কৃষ্ণ ও রাজার রূপে মোহিত করেছেন সবাইকে। রাধার ভুমিকায় শিল্পী জয়ীতা ঘোষ রাহা ও প্রক্ষনার ভুমিকায় বনানী চক্রবর্তী সবার মন ছুঁয়েছেন। দুর্যোধনের ভুমিকায় ছিলেন দিব্যেন্দু তরফদার ও দ্রৌপদীর চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন আদ্রিতা চট্যপাধ্যায়। বাইজু মোহনদাস, বিষ্ণু প্রসাদ পি. এস  ও টি. কে. মনোজের কালারিপায়াট্টর মাধ্যমে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং অন্যান্য গল্প তুলে ধরেছেন যার প্রদর্শনী কল্পনাতীত। স্বাস্থ্যজনিত অসুবিধার কারনে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অলকানন্দা রায় এই প্রোডাকশনে যোগদান করতে পারেননি।
রাতিভাবিকা (অনিন্দিতা ঘোষ, দিপাঞ্জনা গুহ, নম্রতা মুখোপাধ্যায়, পৌলমী মিস্ত্রি, রিয়া রায়) ও রতিভাবকের (যশস্বী চৌধুরী, নবীন চক্রবর্তী, বিক্রান্ত সিংহ, রজত সিঙ্ঘানিয়া, উদয়ন রায়) রূপে দ্রৌপদীর শৃঙ্গারের ব্যাভিচারি ভাব গুলকে খুবই দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তলা হয়েছে। এই শৃঙ্গারের পূর্বাভাস প্রযোজনার শুরুতেই ছৌ শিল্পী তাপস বউড়ি ময়ূর রূপে দর্শকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় উপস্থিত হল মহাভারত এর এক অভিনব ও চিন্তাকর্ষক রূপায়ণ। এছাড়াও সুত্রধর প্রিয়াঙ্কা গুহ দৃপ্ত বাচনভঙ্গি ও কালচক্রের বিবর্তন বোঝাতে চাকার ব্যবহার ছিল প্রশংসনীয়।
চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক চোখরাঙানি কে অতিক্রম করে নারী শক্তির প্রতিবাদ ও বিজয়ের কলরব — স্রষ্টা কলামন্ডলম গৌতম মহাভারতকে অনুষঙ্গ বানিয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন মুক্তি ও স্বাতন্ত্রের এই বার্তা। তাঁর দ্রৌপদী আগুনপাখি, আনুগত্য ও বশ্যতা তার ধর্ম নয়, সে তেজস্বীনীর দাপটে কৃষ্ণের থেকে বস্ত্র নিতে প্রত্যাখান করে এবং পরাক্রমশালী ক্ষত্রিয় কৃষ্ণ ও মাথা নত করে নিতে বাধ্য হয়। আমরা বুঝি মহাভারত ও শ্বাশ্বত সত্য নয়। কথাকলি, কালারিপায়াত্তু, কাইকোট্টিকালি, থেইয়াম, প্রভৃতি নৃত্যশৈলীর সমন্বয়ে সেতু জুড়ে যায় মহাভারত ও রবীন্দ্রনাথের, তৈরী হয় এক বহুমাত্রিক, ব্যতিক্রমী ও বৃহত্তর পটভূমি।
নানাবিধ ঐতিহ্যবাহী শিল্পশৈলীর ব্যবহার, আলো ও শিল্প নির্দেশনা মনে দাগ কেটে যায়। অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চে এসেছিলেন প্রয়াত নৃত্যগুরু ও স্রষ্টা কলামন্ডলম গৌতমের মা, রীতা ঘোষাল যা ছিল উপস্থিত সকলের কাছে এক অত্যন্ত বিশেষ মুহূর্ত।

No comments:

Post a Comment