আজ থেকে অনেকবছর আগের কথা । মাধ্যমিকে দারুণ ভালো রেজাল্ট করে সায়ন্তিকা সায়েন্স নিয়ে উচ্চ - মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে । বুকে একরাশ স্বপ্ন - ডাক্তার হতে হবে তাকে । তার বাবা মা কিন্তু এই স্বপ্ন চাপিয়ে দেননি । এ ইচ্ছে তার একান্তই নিজের । পড়াশুনার পাশাপাশি নাচেও সে সমান পারদর্শী কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক এবং জয়েন্টের চাপে নাচ ছাড়তে হয়েছে তাকে । ইচ্ছে আছে পরে সময় সুযোগ পেলে আবার নাচ শুরু করবে । দিনরাত এককরে পড়াশুনো করে চলেছে সে । উচ্চ - মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবার পর মাত্র একদিন বিশ্রাম নিয়েই আবার বইএর মধ্যে ঢুকে পড়েছে সায়ন্তিকা কারন প্রথমবারেই ডাক্তারিতে চান্স পেতে হবে এবং কোলকাতাতেই পেতে হবে ।
বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সায়ন্তিকা । তার পড়াশুনায় কোন কার্পণ্য করেননি তারা । ভালো ভালো টিচার দিয়েছেন । যখন যে বই দরকার তাই এনে দিয়েছেন অবশ্য সেও তার মর্যাদা রেখেছে । উচ্চ মাধ্যমিকে নব্বই শতাংশের ওপর নম্বর পেয়েছে সেই সঙ্গে জয়েন্টে দারুণ ফল করে কোলকাতা মেডিকেল কলেজে MBBS এ ভর্তি হয়েছে । তাদের কেয়াতলার বাড়ি থেকেই কলেজে যাতায়াত করছে সে । কলেজে তার অনেক বন্ধু তবে মধুরিমার সাথে বন্ধুত্বটা একটু বেশী । মধুরিমা শিলিগুড়ির মেয়ে । ও কলেজ হষ্টেলেই থাকে । ক্লাস অফ থাকলে মাঝেমাঝেই সায়ন্তিকা ওদের হষ্টেলে যায় গল্প গুজব করতে ।
হঠাৎ একদিন মধুরিমা জানায় থার্ড ইয়ারের সৌপর্ণদার খুব পছন্দ সায়ন্তিকাকে । সৌপর্নদাও শিলিগুড়ির ছেলে স্বভাবতই মধুরিমার সাথে সম্পর্ক ভালো ।অনেকদিন ধরেই নাকি ওকে বলছে সায়ন্তিকাকে বলার জন্য , ও ই ইতস্তত করছিল । সৌপর্ণদা সত্যিই ভালো ছেলে ।
ভালো ছেলে যখন তখন তুই ই প্রেম কর না ওর সাথে । আমার দিকে ঠেলছিস কেন ?
আমাকে বললে তো আমি বর্তে যেতাম কিন্তু তোর মতো ফর্সা সুন্দরী বুদ্ধিমতী মেয়ে ছেড়ে আমার মতো কালিন্দী মেয়ের প্রেমে পড়তে সৌপর্নদার বয়েই গেছে ।
তোর টল হ্যান্ডসাম সৌপর্ণদার মেয়ের অভাব হবে না , ওকে অন্যদিকে ছিপ ফেলতে বল - বলেই গটগট করে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা লাগালো সায়ন্তিকা ।
এরপর থেকে মধুরিমার সাথে বন্ধুত্বে একটু ভাঁটা পড়ে তার তবে সায়ন্তিকা খেয়াল করে কলেজে তাকে দেখলেই সৌপর্ণ কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে যায় । হয়ত বন্ধুদের সাথে কথা বলছিল , তাকে দেখেই কথা বন্ধ করে মুখ নামিয়ে নেয় সৌপর্ণ ।
বাড়ি ফিরে সায়ন্তিকারও খুব খারাপ লাগে । মনে মনে সৌপর্ন কে সেও পছন্দ করে কিন্তু তার রাগ সে নিজে মুখে তাকে কেন বলল না ? এতো ভীতু ছেলে হয় নাকি ?
এরকম বেশ কিছুদিন চলার পর একদিন করিডরে একদম মুখোমুখি হয়ে যায় তারা দুজন । যথারীতি তাকে সামনে দেখে মুখ নামিয়ে নেয় সৌপর্ণ । আশেপাশে কেউ না থাকায় সায়ন্তিকা বলে - আমি বাঘ না ভাল্লুক যে আমাকে ভয় পাও ?
উত্তরে সৌপর্ণ বলে - আমি তো কথা বলার অধিকার হারিয়েছি ।
যে নিজের ভালোলাগার কথা নিজে বলতে পারে না তার সাথে আর যেই প্রেম করুক আমি প্রেম করতে পারব না । ভীতু ছেলে কোথাকার !
ভীতু ছেলে আমার একদম না পসন্দ .......
.......... এতক্ষণে কথা ফোটে সৌপর্ণর ।
ঠিক আছে তাহলে আজ নিজেই বলব তবে পাঁচ মিনিট সময় দিতে হবে রাস্তার ওপারে গিয়ে গোলাপ আর ক্যাডবেরি কিনে আনার জন্য । আমি জানি দুটোই তোমার ভীষণ পছন্দের ।
এতো যখন জানো তখন এটা জানতে না যে ভীতু ছেলে আমার পছন্দ নয় ? যাইহোক তোমার জন্য মধুরিমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে । আমাদের দুজনকে তোমার ট্রিট দিতে হবে ।
তুমি বললে আমি আকাশের চাঁদ ও এনে দিতে পারি ।
না থাক , এত কষ্ট করতে হবে না আপাতত কোন একটা রেষ্টুরেন্টে বিরিয়ানি খাওয়ালেই চলবে ।
ঠিক আছে কাল বিকেল পাঁচটায় " সিরাজ " এ দেখা হচ্ছে ।
মধুরিমাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার ।
.................................................
এরপর থেকে মাঝেমাঝেই তাদের কফিহাউসে , রবীন্দ্রসদনে , নন্দন চত্বরে দেখা হতে থাকে কিন্তু পড়াশুনার ব্যাপারে দুজনেই সিরিয়াস ।
সায়ন্তিকা যখন MBBS পাশ করে তখন সৌপর্ণ MD করছে গাইনোকোলজিতে । সায়ন্তিকা এরপর কার্ডিওলজিতে MD করতে দিল্লী চলে যায় ।
MD করে ফিরে এসে দেখে সৌপর্ণ চুটিয়ে প্র্যাকটিস করছে ততদিনে দু বাড়ির লোকই তাদের চার হাত এক করে দেবার জন্য উদ্গ্রীব ।
বিয়ের পর তারা দুজনেই উডল্যান্ডস হসপিটালে জয়েন করে । এমনিতেই ওদের প্রফেশনে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয় তাই এক হসপিটালে থাকলে তবু একসঙ্গে একটু সময় কাটানো যেতে পারে ।
ডাক্তারি এবং ভালবাসায় ভর করে তাদের জীবনতরী এগিয়ে চলতে থাকে ।
বিয়ের তিনবছর পর তাদের ভালোবাসার ফসল অঙ্কুরের জন্ম ।
সৌপর্ণ নিজেই সিজার করতে চেয়েছিল কিন্তু সায়ন্তিকা রাজি হয় নি ।
ও বলেছিল - তুমি যা ভীতুরাম .............. বউ এর কষ্ট দেখে হয়ত মুখ নামিয়ে নিলে তখন আমার এবং বাচ্চা দুজনেরই অবস্থা খারাপ হবে তার চেয়ে বরং মধুরিমার বর সার্থকদা আমার সিজার করুক । সৌপর্ণ সিজার না করলেও OT তে সারাক্ষণ উপস্থিত ছিল ।
ইতিমধ্যে সায়ন্তিকার বাবা এবং সৌপর্ণর মা দুজনেই মারা গেছেন । নাতির টানে সায়ন্তিকার মা ওদের সাথেই থাকে । সায়ন্তিকাও খূব নিশ্চিন্ত মাকে কাছে পেয়ে । শুধু আয়ার ওপর ভরসা করে বাচ্চা মানুষ করায় তার সায় ছিল না । অঙ্কুর হবার পর সায়ন্তিকা প্রাইভেট প্র্যাকটিস একদম কমিয়ে দিয়েছে । সৌপর্ণ ও এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসছে ।
সায়ন্তিকা বলে - আসলের চেয়ে সুদের দর বেশী ? এতদিন তো পেশেন্টের চাপে আমার জন্মদিনও মনে থাকতো না এখন অঙ্কুরের জন্য তো ঠিক তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতে পারছো ।
সৌপর্ণ বলে - বাবা হবার ফিলিংস ই আলাদা , আগে পেশেন্টদের হাসব্যান্ডদের দেখতাম এখন নিজে বাবা হয়ে বুঝছি সারাদিন পরিশ্রমের পর সন্তানের হাসিমুখ দেখলে সমস্ত ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে যায় ।
এভাবেই টক মিষ্টি ঝালে তাদের জীবন ভালোই কাটছিল । অঙ্কুর ও আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে । তাদের দুজনেরই ইচ্ছে একটা নার্সিং হোম করার যেখানে কম পয়সায় রোগীদের একটু ভালো চিকিৎসা দেওয়া যাবে । আমাদের দেশে গরীব মানুষদের বড় কষ্ট ! রোজ রাতে এনিয়ে তাদের আলোচনা চলতে থাকে ।
দিনকয়েক আগে সায়ন্তিকার আন্ডারে রজত ঘোষাল বলে একজন ভদ্রলোক ভর্তি হয়েছেন যার অবিলম্বে হার্ট রিপ্লেসমেন্ট দরকার । ভদ্রলোকের ছোট ছোট দুটো বাচ্চা । ওনার স্ত্রীকে দেখলে সায়ন্তিকার খুব কষ্ট হয় ! সায়ন্তিকা সব ডিপার্টমেন্টে জানিয়ে রেখেছে কারো ব্রেন ডেথ হলেই যেন তাকে জানানো হয় ।
...................................................
আজ হাসপাতাল থেকে ফিরেই সায়ন্তিকা শুনল অঙ্কুরের ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ। দিদা তার সাথে ক্রিকেট খেলে নি । তাকে জোরকরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি । সায়ন্তিকা অঙ্কুরের রাগ ভাঙাতে ব্যস্ত হঠাৎ সৌপর্ণর ফোন ...............
সায়ন্তিকা ফোন ধরতেই শোনে একটি অপরিচিত কণ্ঠস্বর - আপনি কি ডাঃ সৌপর্ণ রায় চৌধুরীর স্ত্রী ? তারাতলা মোড়ের কাছে ওনার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে । আপনি তাড়াতাড়ি আসুন ।
আপনারা দয়া করে ওনাকে উডল্যান্ডসে নিয়ে যান , আমি আসছি ।
অঙ্কুরকে মায়ের কাছে রেখে কোনরকমে তৈরী হয়ে যখন সে হসপিটালে এলো ততক্ষণে সৌপর্ণর ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে । অন্যান্য ডাক্তাররা তবুও মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যদি কিছু করা যায় !
এতো দুঃখের মধ্যেও সায়ন্তিকার রজত ঘোষালের বাচ্চাদুটোর কথা মনে পড়ে গেল ।
যেমন ভাবা তেমন কাজ - - - - - - - - - - - - - -
তার এবং সৌপর্ণের অন্যান্য কলিগ ডাক্তাররা তার অবিচল মনোভাব দেখে মুগ্ধ । সেই রাতেই সৌপর্ণর হার্ট রজত ঘোষালের শরীরে প্রতিস্থাপিত হলো । নিজে অপারেশন না করলেও সায়ন্তিকা সেখানে উপস্থিত ছিল আগাগোড়া ।
....................................................................................
আজ সৌপর্ণর শ্রাদ্ধ ........ বাড়ি ভর্তি লোকজন .......
. .............. ওদিকে আজই রজত ঘোষালের ছুটি হবে । মাস তিনেক কড়া নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে তাকে তারপর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে ।
এতো শোকের মাঝেও সে বিকেলে হাসপাতালে এসে রজত ঘোষালকে দেখে এরপর কি করণীয় সব ওনার স্ত্রীকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন ।
সায়ন্তিকার একটাই সান্ত্বনা তার সৌপর্ণ রজত ঘোষালের মাধ্যমেই আরো অনেক বছর বেঁচে থাকবে ॥
No comments:
Post a Comment