জন্মদিন || অমিত কুমার জানা || সাহিত্যগ্রাফি - Songoti

জন্মদিন || অমিত কুমার জানা || সাহিত্যগ্রাফি

Share This
মা কাঁসার থালায় ধান, দূর্বা তুলসীকাঠির মালা, ঘুমসী নিয়ে তৈরী হয়ে আছে। অনেকক্ষণ থেকেই সুমনকে সমসুরে ডেকে যাচ্ছে-"ওঠরে, ওঠ্ কখন থেকে তোকে ডাকছি। আজ তোর জন্মদিন।" সুমনের নাকে বাদশাভোগ চালের তৈরী পায়েসের সুগন্ধ ভেসে এলো। সকালে ওঠার অভ্যাস সুমনের নেই। কিন্তু যখন তার মনে পড়লো আজ নভেম্বরের সাত তারিখ, তার ঘুম ভেঙে গেল। সে দ্রুত ঘুম থেকে উঠে পড়লো। তার চোখ পড়লো দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ফটোটার দিকে। তাহলে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? দু বছর আগে তার মা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সুমন বেশ কিছুক্ষণ মায়ের ফটোটার দিকে তাকিয়ে থাকলো।  সে মনে মনে বেশ আফসোস করলো ' এ জন্মে আর মায়ের হাতের সেই সুস্বাদু পায়েস খাওয়া হবে না।'


মায়ের ফটোটার দিকে তাকিয়ে সুমনের ছেলেবেলার কত স্মৃতি ভেসে উঠলো। কত শত দুষ্টুমির জন্য সে মায়ের কাছে কতই না বকুনি খেয়েছে! বাবা, মা , দাদা এব সুমন এই চারজনের ছোট্ট পরিবার ছিল। অসহ দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করেও তাদের জীবনে তেমন দুঃখ ছিল না। তার কিংবা তার দাদার জন্মদিন এলেই মা কখনো ভুলে যেত না। মায়ের হাতের পায়েসের স্বাদ এখনো যেন সে অনুভব করে। সুমনের চোখ জলে ভেজার উপক্রম হলো।

তার মোবাইলের ডাটা অন করা ছিল। মেসেঞ্জারে মেসেজ আসার টোন বেজে উঠলে তার নজর সেইদিকে চলে গেল। ফোনটা দেখে সে খানিক চমকে উঠলো -বিমানের মেসেজ।
" ভালো আছিস তো? মনে আছে আজ আমার জন্মদিন? সম্ভব হলে আজ সন্ধ্যায় অবশ্যই আসিস। তোর মোবাইল নাম্বারটা সেন্ড কর।"

মেদিনীপুর কলেজে ফিজিক্স অনার্স পড়ার সময় বিমানের সাথে তার পরিচয়। বিমানের বাড়ি মেদিনীপুর শহরেই। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সুমন মেদিনীপুর শহরে চলে আসে। তখন থেকেই সে মেসে থাকতো। তার আজও মনে পড়ে বিমানের সাথে যেদিন প্রথম পরিচয় হয়েছিল সেদিনই বিমান তাকে পুরো মেদিনীপুর শহর দেখিয়েছিল। সেইদিনই সুমন সম্বন্ধে বিমান অনেককিছু জেনেছিল। মাতৃহারা সংগ্ৰামী সুমনের প্রতি সেদিন থেকেই বিমানের মনে সহানুভূতি এবং মহানুভবতা ঘনীভূত হয়েছিল।
তারা তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সেদিনটা ছিল নভেম্বরের সাত তারিখ। সুমন তখনও মেসে সকালের সুখনিদ্রায় নিমগ্ন।  এদিকে বিমান সকাল থেকেই হাজির তার মায়ের হাতের তৈরী পায়েস নিয়ে।  " হ্যাপি বার্থডে সুমন" -এই বলে বিমান সুমনের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল।  সুমন ঘুম থেকে উঠেই সেই পায়েসের সুগন্ধে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ।
সে ভাবতেও পারছিল না যে শহরেও কেউ এমন সুন্দর পায়েস তৈরী করতে পারে। বিমানকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বিমান বলেছিল ,-" আমি জানি পায়েস তোর কত প্রিয়! তাই তোর জন্য আমার মা এটা বানিয়েছে।  আমার মা তো জন্মসূত্রে গ্ৰামেরই মেয়ে।"

সুমন সেদিন সত্যিই ভীষণ খুশি হয়েছিল।  আবার সেইদিনই যে বিমানের জন্মদিন তা সুমনের জানা ছিল না। সে খুব অবাক হলো যখন বিমান তাকে তার জন্মদিনে আমন্ত্রণ করে গেল। বলাবাহুল্য, বিমান তার বাবা মায়ের সামনে সুমনের খুব প্রশংসা করতো। তাছাড়া, সুমনের মেধা এবং সৌজন্যের কারণে বিমানের বাবা মা তাকে ভীষণ ভালবাসতো। ঐ দিন সন্ধ্যায় সুমন বিমানের বাড়িতে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখে বিমানের অনেক শহুরে বন্ধু। সুমন তাদের দেখে কিছুটা সংকুচিত বোধ করছিল। কিন্তু বিমানের মনখোলা ব্যবহারে সুমনও তাদের সঙ্গে একসাথে জন্মদিনের উৎসবে মেতে উঠেছিল।  বিমানের নামে অলংকৃত কেক কাটা হয়েছিল, ভুরিভোজ খাওয়া হয়েছিল জাকজমক করে।
তারপর বিমানের বাবা 'হোন্ডা শাইন' (বাইক)-এর চাবিটা দিয়েছিল তার হাতে। সুমন তো একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিল- জন্মদিনে বাইক উপহার!
তারপর বিমান বাইক স্টার্ট দিয়ে সুমনকে পেছনে বসতে বললো। সুমন দ্বিধাগ্ৰস্ত অবস্থায় বসে পড়েছিল। বিমান ঝড়ের বেগে বাইক চালাতে শুরু করলো এবং সুমনকে বললো, -"তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তোকে ছাড়া এত মজাই হতো না।"
সুমন বিমানকে ধীরগতিতে বাইক চালাতে বললো। কিন্তু বিমান শুনলো না। এভাবেই দুবন্ধুর জন্মদিন টা বেশ আনন্দমুখর কেটেছিল।

তারপর বিমান ফিজিক্স অনার্স ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গিয়েছিল চেন্নাই। আর সুমন মেদিনীপুরে মেসে থেকে ফিজিক্স অনার্স পড়া চালিয়ে যাচ্ছিল। বিমানের পুরানো মোবাইল নাম্বারে অনেকবার ফোন করেও তাকে পায়নি সুমন। প্রায় সাত বছর তাদের মধ্যে কোনরূপ যোগাযোগ ছিল না। সুমন এখন ফিজিক্সের শিক্ষক এবং বিমান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
কিন্তু আজ হঠাৎ বিমানের মেসেজ পেয়ে সুমন তাদের একবছরের বন্ধুত্বের দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে নিমজ্জ্বিত হলো। সে আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো জন্মদিনের উপহার কিনতে। আজ সন্ধ্যায় তাকে বিমানের বাড়ি যেতে হবে তো। সাত বছরের পুরানো বন্ধুত্বের সম্পর্কের বন্ধন এত সহজে শিথিল হতে দেওয়া চলে না। আজ এই জন্মদিনে পুনরায় তারা মিলিত হবে, পুনরায় একবার তারা বন্ধুত্বকে আঁকড়ে ধরে জন্মদিনের আনন্দে মেতে উঠবে।

No comments:

Post a Comment