প্রবাসী ছেলের চিঠি || অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় || সাহিত্যগ্রাফি - Songoti

প্রবাসী ছেলের চিঠি || অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় || সাহিত্যগ্রাফি

Share This

মা ,
আজ তোমার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে ! মনে হচ্ছে আজ যদি তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শুতে পারতাম ! ফোন তো রোজই করি , আজ ভীষণ চিঠি লিখতে ইচ্ছে হলো ।
       আজ বিজয়া দশমী । কোলকাতার মতো চারদিন তো আমাদের এখানে পুজো  হয় না । উইক এন্ডে শনি রবিবার পুজো  হয় । এইমাত্র আমরা বিসর্জন দিয়ে ফিরলাম অবশ্য শুধু ঘট । প্রতিবার তো প্রতিমা আনা সম্ভব হয়না তাই একই প্রতিমায় বার চারেক পূজো হয় এখানে । তুমি কি বিসর্জন দেখতে গিয়েছিলে ? তোমাদের বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার রাতুলদা গতকাল আমায় বলেছিলেন যে তোমাদের সকলকে নিয়ে বিসর্জন দেখতে যাবেন ।

মনে আছে মা ,  ছোটবেলায় আমি তোমার সাথে ঠাকুরবরণ করতে যেতাম ,  তুমি ঠাকুরের পায়ে ছোঁয়ানোর জন্য বই নিয়ে যেতে বলতে আর আমি শুধু অঙ্ক আর ভূগোল বই নিয়ে যেতাম কারন এই দুটো সাবজেক্টেই তো আমি কম নম্বর পেতাম আর আজ আমি অঙ্কের  আংশিক সময়ের অধ্যাপক ,  তাও বিদেশে ! সব ঠাকুরের পায়ে এমনকি অসুরের পায়েও ছোঁয়াতাম যাতে নম্বরটা একটু ভালো হয় ! তারপর বাড়ি ফিরে ঠাকুরের আসনের সামনে তুমি ঘট পাততে আমের পল্লব দিয়ে । ওই সিঁদুর মাখা লাল মুখেই তুমি নাড়ু আর নিমকি বানাতে বসতে ।  আজও আমি চোখ বুজে তোমার সিঁদুর মাখা লাল সুন্দর মুখটা দেখতে পাই ।  এরপর বাবা ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে ফিরলে তুমি আর বাবা আমাকে ধান দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করতে আর বলতে আমার ছেলের চঞ্চলতা একটু কমিয়ে দাও ঠাকুর । আমি কিন্তু এখন আর সত্যিই চঞ্চল নেই মা ! এরপর তো তোমার বানানো নাড়ু খেয়েই আমার পেট ভরে যেত । আজ এতো বছর পরেও আমি সেই নাড়ুর স্বাদ ভুলতে পারিনি ।
        বাবা মারা যাবার পর তুমি ঠাকুর বরণ করতে যেতে না কিন্তু ঘট পাতা নাড়ু নিমকি সব বানাতে । আমি যে বড্ড ভালবাসতাম তোমার বানানো নারকেলের নাড়ু !
     
গতবার তোমার শরীর খারাপের খবর শুনে কোলকাতায় গিয়ে তোমাকে দেখে আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম । তুমি ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই মা ! তোমায় সুস্থ করে তাই বাড়িতে না রেখে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলাম । এতে মামা , কাকারা হয়ত আমার ওপর রাগ করেছে কিন্তু আমি তো জানি তুমি কারো গলগ্রহ হয়ে থাকতে চাও না । এর থেকে বৃদ্ধাশ্রম অনেক ভালো । এখানে প্রতিদিন ডাক্তার আসেন তোমায় চেকআপ করতে । সাবিত্রী কাকিমা , ডলি কাকিমা , শোভনা মাসীমা আছেন তোমার সঙ্গী । তাদের সাথে গল্প করে তোমার সময় কাটছে । বাড়িতে সর্বক্ষণ আয়া , রান্নার লোক রেখেও আমি তোমার একাকীত্ব কাটাতে পারতাম না ।
তবে এবার তোমাকে একটা সুখবর দিই । আমার PHD এ মাসেই শেষ হচ্ছে । আগামী মাসেই আমার রেজাল্ট বেরোবে । সম্ভবত ডিসেম্বরের পনের তারিখের মধ্যেই আমি তোমার কাছে ফিরে যাচ্ছি ।  এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তোমার বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে তোমায় নিয়ে বাড়ি ঢুকবো । এ কটা দিন একটু কষ্ট করো । আমি তো মাস দেড়েকের মধ্যেই ফিরে আসছি । গিয়েই কিন্তু নাড়ু খাব ।
আর হ্যাঁ , রাতুল দা বলছিলেন তুমি নাকি প্রেসারের ওষুধ খেতে চাও না , ওটা কিন্তু বন্ধ করা যাবে না । বেশী পান জর্দা খাবে না কিন্তু । ডাক্তার কাকু বারণ করেছেন । রাতে একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে শোবে । এসময় ভোরের দিকে একটু ঠান্ডা পড়ে ।
সাবধানে থাকবে । তুমি আমার বিজয়ার প্রণাম নেবে । অন্য কাকিমা , মাসিমাদের আমার প্রণাম জানাবে ।
খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে । আজ আবার তোমার গন্ধমাখা রুমাল টা বের করতে হবে নাহলে যে আমার ঘুমই  আসবে না ।
        তুমি আমার বিজয়ার প্রণাম নিও.  অন্যান্য কাকিমা ,  মাসিমা ও রাতুল দাকে আমার প্রণাম জানিও.
সাবধানে থেকো.  ভালো থেকো.
                                  ইতি                               
                            তোমার রোদ্দুর. 

No comments:

Post a Comment