স্বজন || রীণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায় || সাহিত্যগ্রাফি - Songoti

স্বজন || রীণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায় || সাহিত্যগ্রাফি

Share This

'চোর—চোর—চোর'
'ধর,ধর,মার,মার'—বহু মানুষের সম্মিলিত চিৎকারে আমার তন্দ্রা ছুটে গেল ৷
হাওড়া স্টেশনের ওয়েটিং জোনে বসেছিলাম বাড়ি ফেরার ট্রেণের অপেক্ষায় ৷কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি ৷থাকি আন্দুলে ৷আন্দুল থেকে ট্রেণে হাওড়া তারপর বাসে কলেজষ্ট্রীট—এই হল আমার নিত্য যাতায়াতের পথ ৷এই পথপরিক্রমায়  হাওড়া স্টেশন হল আমার কাছে সেতুবন্ধন রামেশ্বরমের মত ৷গত পাঁচ/ছয় বছরে হাওড়া স্টেশন আমার দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠেছে ৷প্রায়ই ট্রেণ লেট থাকে ৷ওয়েটিং জোনে বসি,জল খাই,টিফিন খাই আর নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করি স্টেশনচত্বরের জীবনযাত্রা ৷ কতরকমের দোকান এখানে—কি পাওয়া যায় না সেখানে! স্টেশনচত্বরেই রেলের উচ্চপদস্হ আধিকারিকদের কোয়ার্টার ৷কতরকমের মানুষ আসে এখানে ৷পুলিশ,হকার,দূরপাল্লার যাত্রী,নিত্যযাত্রীর কলকোলাহলে সরগরম হাওড়া স্টেশন চব্বিশ ঘন্টাই প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ থাকে ৷বহু মানুষের বাসস্হান এই স্টেশন চত্বর ৷ অনেক শিশুর এখানেই জন্ম,এখানেই বেড়ে ওঠা ৷বসে  বসে চারপাশের চলমান জীবনের ছবি দেখি,ভালো লাগে ৷
    আজ কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে ৷সব ট্রেণই লেট ৷একসঙ্গে ৩/৪টে ট্রেণ আসছে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ৷থিকথিকে ভিড়, স্রোতের মত মানুষ চলেছে ৷জনতার ঢেউ উঠছে, নামছে ৷আজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ছিল ৷ অনেক ভোরে উঠেছি,বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখটা লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি ৷ হঠাৎ এই 'চোর—চোর' চিৎকার ৷ তাকিয়ে দেখি প্রচুর মানুষ দৌড়াচ্ছে আর চোর,চোর বলে চেঁচাচ্ছে ৷ মারমুখী জনতার ফাঁকফোকর গলে দৌড়ে পালাচ্ছে একটা ১২/১৩বছরের ছেলে ৷প্রাণপনে দৌড়েও ছেলেটি ধরা পড়ে গেল ৷চলল এলোপাথাড়ি মার—চড়,ঘুঁষি ৷ছোট ছেলে বলে মায়া দেখাচ্ছে না কেউ —ও যে চোর !ছেলেটা বাঁচবার জন্য বারবার জনতার হাত ছাড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করছে,হাতজোড় করে বলছে—'আমি চুরি করিনি' ৷কিন্তু কে শোনে কার কথা ! নির্যাতন চলতেই থাকে ৷
   হঠাৎ একটা বজ্রকন্ঠের আওয়াজ শোনা যায়—'থামুন,থামুন আপনারা' ৷জনতা কিছুক্ষনের জন্য থমকে যায় ৷পরমুহূর্তেই শুরু হয়ে যায় আবার মারধোর ৷এবার সেই ছয় ফুট চার ইঞ্চির ভদ্রলোকটি ছেলেটিকে স্তম্ভের মত আড়াল করে    দাঁড়ান,বলেন—'ও চুরি করেনি, আপনারা থামুন এবার' ৷দীর্ঘদেহী মানুষটির সবলতা আর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব কিছুক্ষনের জন্য জনতাকে স্তব্ধ করে দেয় ৷ ভদ্রলোক বলেন—'আমি হাওড়ার এক্স পুলিশ সুপার ৷আমি জানি কাজটা কে  বা কারা করেছে' 'জানেন যদি তবে তাকে ধরছেন না কেন?ভিড়ের ভিতর থেকে মন্তব্য ভেসে আসে ৷ভদ্রলোক বলেন—'আগে বলুন কার কি চুরি গেছে'?জনতা মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করূ ৷একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করে— কার চুরি গেছে, কি চুরি গেছে? দেখা গেল, কেউই জানেনা কার কি চুরি গেছে ৷
'আশ্চর্য!কি চুরি গেছে তাই আপনারা জানেন না! অথচ 'চোর' বলে একজনকে মারছেন!ধমক দেন ভদ্রলোক ৷সবাই আমতা আমতা করতে থাকে ৷আসলে পথচলতি মানুষরা একটু 'হাতের সুখ' করতে এসেছিলেন বোঝা গেল ৷ভদ্রলোকের প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে ভিড় পাতলা হতে শুরু করে ৷

হঠাৎ এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে বলেন—'আমার ব্যাগ চুরি গেছে' ভিড় করে থাকা মানুষরা একটু সাহস পেয়ে বলেন—'হ্যাঁ, বলুনতো দিদি,উনি তখন থেকে আমাদের ধমকাচ্ছেন!' ভদ্রমহিলা বলেন—'আমার ব্যাগ চুরি গেছে ৷ওতে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি ছিল' ৷
 'চোর' বলে মার খাওয়া ছেলেটি এক্স পুলিশ সুপারের সহানুভূতি ও সমর্থন পেয়ে ততক্ষনে উঠে বসেছে ৷ ওর সারা শরীরে কালশিটের দাগ,ঠোঁটের কোনে রক্ত জমে আছে ৷ এত খারাপ লাগছিল ছেলেটার জন্য!
ভদ্রলোক কাকে যেন একটা ফোন করলেন ৷কিছুক্ষনের মধ্যে বছর ছাব্বিশের ছিপছিপে একটি ছেলে 'নমস্কার স্যার,' বলে হাত জোড় করে তার সামনে এসে দাঁড়ায় ৷তার মাথায় ফেট্টি,গলায় স্কার্ফ ৷
ততক্ষনে মারমুখী জনতার অধিকাংশই সরে পড়েছে ৷কিন্তু রহস্যের গন্ধ পেয়ে প্রচুর লোক এসে জুটেছে চারপাশে ৷ভদ্রলোক বললেন—'ন্যাড়া,এই ভদ্রমহিলার ব্যাগ চুরি গেছে ৷আমি জানি, এ তোর দলের লোকের কাজ ৷এক্ষুনি ফেরৎ দেবার ব্যবস্থা কর ৷তোদের কাজের জন্য একটা নিরীহ ছেলের প্রাণ যেতে বসেছিল!'
ন্যাড়া বলল—'হ্যাঁ স্যার, দেখছি স্যার" ৷
পুলিশ সুপার থাকাকালে ভদ্রলোক, মানে অনিল চ্যাটার্জী ছদ্মবেশে ন্যাড়া ও তার গ্যাং এর সাথে মিশে পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষভাবে জেনেছিলেন
ওদের কর্মপদ্ধতি ৷পুরো গ্যাংটাকে অনিলবাবু গ্রেফতার করেছিলেন ৷জেলও খেটেছিল ওরা ৷পরে ভাল কাজের রেকর্ড দেখিয়ে ছাড়া পায় ৷এরই মধ্যে ভিড় ঠেলে একটা রোগাপাতলা ছেলে এগিয়ে আসে ন্যাড়ার দিকে ৷'কি গুরু,তুমি এখানে?' 'এক্ষুনি কোন ব্যাগ পেয়েছিস?'কড়াস্বরে বলে ন্যাড়া ৷
'হ্যাঁ, পেয়েছি তো ৷কিন্তু ওতে টাকাপয়সা কিস্যু নেই ৷এইমাত্র ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম' ৷
ডাস্টবিনের কথা শুনে ব্যাগ চুরি যাওয়া সেই ভদ্রমহিলা আৎকে উঠেন ৷'সেকি! কোন ডাস্টবিনে?ওতে আমার মহামূল্যবান জিনিস আছে ৷ওটা যে আমার চাইই' ৷পাগলের মত করতে থাকেন ভদ্রমহিলা ৷উপস্থিত সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠি ৷টাকাপয়সা নেই ব্যাগে ,তাহলে কি আছে?' অনিলবাবুর নির্দেশমত ন্যাড়া ও সেই ছেলেটি ডাস্টবিন থেকে ব্যাগটি উদ্ধার করে আনে ৷ভদ্রমহিলা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েন ব্যাগের উপর ৷চেন খুলে বার করে আনেন একটা ছবি—একটা মেয়ের ছবি ৷তারপর ছবিটি বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকেন ৷
   জানা যায়, ছবিটি ওনার মেয়ের ?নাম পদ্মা পাইন—পর্বতারোহী ৷বহু শৃঙ্গ জয় করে দেশের গৌরব বাড়িয়েছেন ৷শেষবার অভিযানে বেরিয়ে তুষারঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ হয়ে গেছেন ৷চল্লিশ দিন হয়ে গেল এখনও তার দেহের হদিশ মেলেনি ৷একমাত্র সন্তানের ছবিটুকুই মায়ের শেষ সম্বল ৷সত্যিইতো তা মহামূল্যবান!

'চোর' বলে মার খাওয়া সেই ছেলেটা এগিয়ে এসে ভদ্রমহিলার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললে,—'তুমি কেঁদ না, আমি তো আছি' ৷ ভদ্রমহিলা আবেগে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেটিকে ৷
দেশবিখ্যাত পদ্মা পাইনের মা আর হাওড়া স্টেশনে আগাছার মত বেড়ে ওঠা ছেলেটার মধ্যে কোন তফাৎ রইল না ৷
দাঁড়িয়ে দেখলাম,অনিলবাবু,ন্যাড়া,তার সাগরেদসহ স্টেশন চত্বরের গোটা ভিড়টা এই অনির্বচনীয় দৃশ্য দেখছে  অপলকে  ৷
  মনে মনে বললাম—'এই তো আমার ভারতবর্ষ, এক,অভিন্ন সত্তার ভারতবর্ষ' !
  আমার ট্রেণ এসে গিয়েছিল ৷অদ্ভূত সুন্দর একটা অনুভূতি নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম ৷

No comments:

Post a Comment