মালদা নিয়ে টানাটানি - Songoti

মালদা নিয়ে টানাটানি

Share This
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যের ঐতিহাসিক রিসার্চ পড়তে ক্লিক করুন - পড়ুন

মালদা নিয়ে টানাটানির অন্ত নেই। সেই কবে থেকেই চলছে এই টানাপোড়েন। প্রদীপদার সঙ্গে কত বার যে কথা হয়েছে মালদা নিয়ে, গোনা যাবে না। তারপর তো কে কে যাবে, খবর নিতে পোস্ট দেওয়া, সাড়া পেয়ে আনুমানিক সংখ্যা বিচার করে এত লোকের জন্য একটা হোটেল ব্যবস্থা করা, সেখানে আবার অনুষ্ঠান করার জায়গা থাকতে হবে, এসব দেখা। ফোনের পর ফোনে মালদার একের পর এক হোটেলের খবর নেওয়া। তারপর একদিন রাতে ট্রেনে চেপে তিনমূর্তির মালদা অভিযান। সেখানে ঘর দেখে, রেস্টুরেন্টে পয়সা খরচা করে খেয়ে, কবে কি খাব, তার নির্ঘন্ট তৈরি করা।


সব শেষে টানাটানি মালদা সফরের ব্যবস্থা নিয়ে। গৌড় আর পাণ্ডয়া দুটি আলাদা দিকে। একদিনে ঘোরা যায়, অবশ্যই যায়, ঝটিকা সফর হয়, কিন্তু সারাদিন লেগে যায়। প্রদীপদা বললেন, তাহলে তো কবিতা উৎসব মার খাবে! ঠিক কথা। দু-দিনে দু-দিক ঘোরার সিদ্ধান্ত হল। কিন্তু বেড়াবো কীসে? ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে তো টোটো চলবে না। শান্তিনিকেতনে ঘুরেছিলাম রিক্সায়, মূর্শিদাবাদে টোটোতে। এখানে টোটো তো চলবে না। তাহলে টাটা সুমো? কিন্তু, এত লোকের জন্য গোটা ১৫ টাটা সুমো নিয়ে ঘোরা, অবাস্তব। তাই চেষ্টা হচ্ছে বাসের। দুটি বাসে হলে আমরা আনন্দে হৈ হৈ করে বেড়াতেও পারবো আর সময়ে ফিরে এসে কবিতা উতসবের প্রস্তুতিও নিতে পারব। এরপর জানি না, বাসেও কুলোবে কি না! যুগ সাগ্নিকের শ্রীবৃদ্ধির গতি যে মুদ্রাস্ফীতির চেয়েও বেশি!



কিন্তু, এত যে মালদা-মালদা করছি, সে কি ছিল? আদৌ ছিল মালদা? ছিল না। ইংরেজদের আমলের শুরুর দিকেও ছিল না। মল্লরা, মানে মল্ল রাজার বংশধরেরা ছিল। মাল বা মালো-রা ছিল। মলদ-রাও ছিল। এমনকি দহগুলিও ছিল। কিন্তু, মালদা বা মালদহ ছিল না।



এখন যে মালদা দেখেন, তার পশ্চিমে বিহার, আর পূর্বে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ। উত্তরে দিনাজপুর আর দক্ষিণে গঙ্গা। ইংরেজরা যখন এদেশের শাসন ব্যবস্থা দখল করা শুরু করল, তখন বর্তমানে মালদা বলে পরিচিত ভূখণ্ডটি বিভক্ত ছিল। খানিকটা ছিল পূর্ণিয়া জেলায় ও বাকিটা অবিভক্ত দিনাজপুর জেলায়।



১৮৫৮-র আগে আলাদা একটি জেলা এল – মালদহ। প্রশাসনের প্রয়োজনে ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৬ পর্যন্ত মালদহ জেলাকে রাখা হল রাজশাহী বিভাগে।



১৮৭৬ সালে মালদহ জেলাকে রাজশাহী বিভাগ থেকে কেটে এনে ভাগলপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু, ব্রিটিশের মতিগতি আবার বদলায় এবং ১৯০০ সালে মালদহকে ফের রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত করা হয়।



এই টানাটানি কেন, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ পাওয়া যায়নি, কেবল প্রশাসনিক যুক্তি ছাড়া। স্বাধীনতা সংগ্রাম হল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হল, পতাকা উড়লো, মানুষ আনন্দ করলেন, ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ শুনলেন। তার দুদিন পর, ১৭ অগস্ট তারিখে শিবগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, ভোলাঘাট, নাচোল ও গোমস্তাপুর থানা বাদে অবশিষ্ট মালদহ জেলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হল।



একসময় রাজশাহী বিভাগ থেকে ভাগলপুর, ফের ভাগলপুর থেকে রাজশাহী বিভাগে ছিল মালদহ। স্বাধীনতার পর এই জেলা এল জলপাইগুড়ি বিভাগের অধীনে। এই বিভাগে এখন মালদহ থেকে কোচবিহার জেলাগুলি রয়েছে।



মালদহ জেলা হওয়ার আগে এর পরিচিতি তিনটে – রাঢ়, গৌড় আর লক্ষ্মণাবতী। কিন্তু, রাঢ়ের সঙ্গে গৌড়ের, গৌড়ের সঙ্গে লক্ষ্মণাবতীর সম্পর্ক নিয়েও মতভেদ আছে। মানে, ঐ টানাটানি আর কি! কারও কারও মতে, রাঢ় অঞ্চল গৌড়ের অন্তর্গত ছিল।



একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর কৃষ্ণ মিশ্র তাঁর ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ গ্রন্থে  রাঢ়াপুরী (রাঢ়) ও ভুরিশ্রেষ্ঠিকার উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, রাঢ় তো বটেই, ভূড়িশ্রেষ্ঠিকাও গৌড়ের অন্তর্গত ছিল। ভুড়িশ্রেষ্ঠিকার আরেকটি গল্প পরে বলছি। কৃষ্ণ মিশ্রকে সমর্থন করেননি ‘যাদবরাজ’ প্রথম জয়তুগি। তাঁর ‘মানাগোলি’ শিলালেখ থেকে জানা যায়, লালা (রাঢ়) ও গৌল (গৌড়) ছিল পৃথক দুটি অঞ্চল।



ইতিহাসের মতে, লক্ষ্মণ সেনের প্রতিষ্ঠিত রাজধানী লক্ষ্ণৌতি বা লক্ষ্মণাবতী নগরীর ধ্বংসাবশেষ আধুনিককালে গৌড় নামে পরিচিত। অর্থাৎ, লক্ষ্মণাবতীকে আত্মস্থ করেছিল হুসেন শাহর গৌড়। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর জৈন লেখকদের রচনায় প্রকাশ, আধুনিক মালদহ জেলায় অবস্থিত লক্ষ্মণাবতীও গৌড়ের অন্তর্গত ছিল। মুসলমান যুগের আদিপর্বে গৌড় বলতে অধুনা মালদহ জেলার লক্ষ্মণাবতী শহরটিকেই বোঝাত। কোনো কোনো প্রাচীন নথি থেকে জানা যায়, পুণ্ড্রবর্ধনও গৌড়ের অন্তর্গত ছিল। পুণ্ড্রবর্ধনেরই এখনকার নাম পাণ্ডুয়া, যেখানে আছে ইতিহাস বিখ্যাত আদিনা মসজিদ।



পাল রাজাদের নানা গ্রন্থে ‘বঙ্গপতি’ ও ‘গৌড়েশ্বর’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন জনপদের মধ্যে ‘বঙ্গ’ ছিল আরও পশ্চিমে, আর গৌড় আজকের মালদার একাংশে। সেন রাজাদের কিন্তু শুধুই গৌড়েশ্বর বলা হত। অর্থাৎ, তাদের আমলে বঙ্গ-র কর্তৃত্ত্ব সেন রাজাদের অধিকারে আসেনি? তবে, এটুকু নিশ্চিত, গৌড় ও বঙ্গ – দুটি নামই বাংলার নাম ছিল।



প্রাচীন বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। তাঁর রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার সদর বহরমপুর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কর্ণসুবর্ণ। আনুমানিক ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী এক সময়ে তিনি রাজত্ব করেছিলেন। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং কর্ণসুবর্ণ থেকে উড়িষ্যার উপকূলের একটি অঞ্চলে এসে উপস্থিত হন। সমগ্র অঞ্চলটিই শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল বলে জানা যায়।



এই উড়িষ্যার উপকূলবর্তী এলাকায় আজও আছে মোগলমারি, যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছে দন্তবিহার। শোনা যায়, দন্তবিহার থেকেই এই এলাকার নাম হয় দাঁতন। এর কাছেই আছে শঙ্কসেনার ঢিবি। শঙ্কসেনা আসলে রাজা শশাঙ্কের নাম থেকে এসেছে। 

No comments:

Post a Comment