সীতার জন্মদিন রাম ভক্তদের কাছেই অবহেলিত? (পর্ব ২) - Songoti

সীতার জন্মদিন রাম ভক্তদের কাছেই অবহেলিত? (পর্ব ২)

Share This
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : নিঃশব্দেই কেটে গেলো সীতার জন্মদিন।বৈশাখী শুক্লা নবমী। জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে যারা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তোলেন , সবাই চুপ।তবে কি রামভক্তদের কাছে সীতার তেমন গুরুত্ব নেই? পুরাণ কাহিনিগুলিও অবশ্য বলছে , সীতা রামের কাছেও ব্রাত্য, ভক্তদের কাছেও ব্রাত্য।


অযোধ্যায় ফিরে আসার পর নাকি প্রজাদের মধ্যে সীতার সতীত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। গুপ্তচরের মারফত সে সংবাদ এসে পৌঁছয় রাজা রামচন্দ্রের কাছে। প্রজাবৎসল রাজার কাছে নিজের বিবাহিতা স্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব প্রজার। তাই তিনি স্ত্রী ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। কি বলেন সীতাকে?
রাম বললেন, তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে।,,,,,,এই দশদিক পড়ে আছে। যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যাও, আমি অনুমতি দিলাম তোমাকে । তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই। কোন্ সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহে বাস করেছে যে স্ত্রী,তাকে ফিরিয়ে নেবে?রাবণের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার দৃষ্টিতে দৃষ্টা তুমি, তোমাকে গ্রহণ করে আমি আমার উজ্জ্বল বংশের গৌরব নষ্ট করব? যে জন্য যুদ্ধ জয় করেছি , তা পেয়েছি, তোমার প্রতি আমার অভিলাষ নেই, যেখানে খুশি চলে যাও । তুমি বুদ্ধিমান, আমি তোমাকে বলছি লক্ষ্মণ,ভরত,শত্রুঘ্ন,সুগ্রীব বা বিভীষণ এদের মধ্যে যাঁকে ইচ্ছা মনোনীত করে নাও।তোমার মত দিব্যরূপা মনোরমা নারীকে দেখে রাবণ নিজগৃহে খুব বেশিদিন  চুপচাপ সহ্য করেনি।(৬/১১৫/১৫_২৪)।(বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা/সুকুমারী ভট্টাচার্য/ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড)।
লক্ষ্য করুন রাম তাঁর উজ্জ্বল বংশের কথা বলছেন। সীতাকে বলছেন রামের বদলে যে কাউকে বেছে নিতে। যাঁদের বেছে নিতে বলছেন, তাঁরা কিন্তু প্রত্যেকেই বিবাহিত। অর্থাৎ সীতা যদি কাউকে বেছেও নিতেন তাহলে তিনি হতেন দ্বিতীয়া স্ত্রী। অর্থাৎ সে যুগে বহু স্ত্রী প্রথা ছিল। সময়টা আদি সনাতন বৈদিক যুগ। আমরা জানি দশরথের ছিল তিন স্ত্রী।কিন্তু যেটা জানিনা,  দশরথের ছিল আরও ৩৫০জন স্ত্রী। এই প্রসঙ্গে কঙ্কর সিংহ তাঁর ধর্ম ও নারী প্রাচীন ভারত গ্রন্থের (প্রকাশক রেডিক্যাল ইম্প্রেশন) এ রামায়ণ ও নারী প্রবন্ধে লিখেছেন_রামায়ণের মূল কাহিনী শুরু হয়েছে অপুত্রক রাজা দশরথের পুত্র লাভের কামনায় পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞের মাধম্যে , যে যজ্ঞ করে রাজা দশরথ তিন রানী কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রার কাছ থেকে চার পুত্র লাভ করেন। রাম , লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন। এই তিন প্রধা না রাণী ছাড়াও আরও তিনশত পঞ্চাশজন পত্নী ছিল দশরথের। যাদের কাছ থেকে দশরথ কোনও পুত্র লাভ করতে পারেননি।,,,এই পত্নীদের সকলেই ক্ষত্রিয় কন্যা ছিলেন না। বৈশ্য ও শুদ্র কন্যারাও ছিলেন।কৃত্তিবাস আবার দশরথের সাতশত পঞ্চাশ জন পত্নীর কথা বলেছেন যা বাল্মীকি রামায়ণের পত্নী সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি।,,,কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় মনে করেন দশরথের চারপূত্রই ক্ষেত্রজ পুত্র।,,,,রামায়ণের চার ভ্রাতার প্রকৃত জনকরূপে কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় ঋষি   ঋষ্যশৃঙ্গ কে চিহ্নিত করেছেন।

আবার সীতাই যে রামের একমাত্র স্ত্রী সেটা মানেন না সংস্কৃত সাহিত্যের ব্রিটিশ অধ্যাপক ড: জে এল ব্রোকিংটন। তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ন্যায়পরায়ণ রাম  এ তিনি লিখেছেন,দশরথ রামকে উত্তরসূরি ঘোষণা করতেই কৈ কেয়ীকে মন্থরা বলে,এরফলে রামচন্দ্রের রমণীরা খুশি হবে, তোমার পুত্রবধূ কষ্ট পাবে।পরে রামের অভিষেকের সময় শত্রুঘ্ন সাজাচ্ছেন রাম লক্ষ্মণ কে। কৌশল্যা সাজিয়েছেন রাঘব পত্নীদের।এই সংবাদটি প্রচারিত হয় আনন্দবাজারে গত ১অক্টোবর ১৯৮৪ সালে।
রাম সীতাকে বলছেন, রামের পরিবর্তে অন্য পুরুষ বেছে নিতে। হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীল মানুষজন প্রচার করেন সনাতন ধর্মে নারীর নাকি অনেক সম্মান ছিল। অথচ গবেষক সুকুমারী ভট্টাচার্য বৈদিক যুগে নারীর অবস্থান কি ছিল সেই সম্পর্কে কি বলেছেন কিঙ্কর সিংহ তাঁর ধর্ম ও নারী প্রাচীন ভারত গ্রন্থের প্রাচীন সাহিত্যে নারী নিন্দা প্রবন্ধে ৫৯পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।
বারবার বলা হয়েছে যে নারীর সভায় যাবার অধিকার নেই।(মৈত্রায়নি সংহিতা ৪/৭/৪) কোনো শিক্ষা পাবার , ধন অর্জন বা স্বাধীনভাবে ভোগ করবার ,এমনকি নিজের দেহটিকে ও অবাঞ্ছিত সম্ভোগ থেকে রক্ষা করবারও অধিকার তার নেই। ( মৈত্রায় নী সংহিতা ৩/৬/৩ ;৪/৬/৭; ৪/৭/৪;১০/১০/১১; তৈত্তি রীও সংহিতা ৬/৫/৮/২) ,,,,,,,তাহলে বৈদিক ভারত কী চোখে দেখেছিল নারীকে? নারী অশুচি, স্বভাবত পাপিষ্ঠা ও অমঙ্গলের হেতু ।
সেযুগে নারীর ছিল দুটি সংজ্ঞা। সে পুত্রের জননী ও ভোগ্য বস্তু। এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ বৈদিক সাহিত্য ও হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রে আছে।
প্রশ্ন,রামের এই অপমান কি সীতা মুখ বুঝে সহ্য করে গেছেন? পুরাণ গবেষক নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ গ্রন্থে লিখেছেন, সীতা এত অপমান সহ্য করতে পারেন নি। রামকে বলেছেন, অসভ্য ছোট লোকেরা অসভ্য মেয়ে দের সঙ্গে যেমন করে কথা বলে , তুমি সেই রকম বলছ। _ প্রাকৃত: প্রাকৃতামিব।,,,,,,,,,
সীতা লক্ষ্মণকে বললেন, চিতা প্রস্তুত করার জন্য। চিতা তৈরি হতে  সীতা বলেন,ভগবান আদিত্য,বায়ু,চন্দ্র,দিন,সন্ধ্যা, রাত্রি,পৃথিবী সহ সব দেবতারা,আপনাদের জানাই, আমি যদি সত্যি চরিত্রবতী হই, আমাকে রক্ষা করুন।
অনেকেই জানেন রামায়ণে আর এক ব্রাত্য মহিলা চরিত্র শান্তা। রামের দিদি। জন্মের পর তাকে কৌশল্যা তার বোনকে দত্তক দিয়ে দেন।কারণ? সেই উত্তর রাম ভক্তদের জন্য তোলা থাক।শুধু এটুকু জানি , রামের ক্ষেত্রজ  পিতা ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গ  বিয়ে করেন রামের দিদি শান্তাকে? তাহলে রামের সঙ্গে এই ঋষির সম্পর্ক কি দাঁড়ালো?
বারবার অপমানিত সীতা অগ্নিপরীক্ষা দিতে রাজি হননি। বসুন্ধরাকে আহ্বান করে পাতালে চলে যান সীতা।ট্র্যাজিক পরিণতি হয় লক্ষ্মণ আর রামচন্দ্রেরও। দুজনেই আত্মহত্যা করেন সরযূ নদীতে ডুবে। অবহেলিত ব্রাত্য চরিত্র সীতা। তাই রাম ভক্তরা সীতার জন্মদিন পালনে উৎসাহী হবেন না । এটাইতো স্বাভাবিক।

No comments:

Post a Comment