রাবণের সীতা হরণের আগেও একবার সীতা হরণের চেষ্টা হয়েছিল - Songoti

রাবণের সীতা হরণের আগেও একবার সীতা হরণের চেষ্টা হয়েছিল

Share This
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : স্ত্রীর আবদার রাখতে স্বর্ণমৃগ ধরতে গেলেন  রামচন্দ্র। আর্তনাদ শুনে পিছু নিলেন ভ্রাতা লক্ষ্মণ। করোনা মার্কা গণ্ডি কেটে বৌদিকে ঘরে থাকার নির্দেশও দিয়ে গেলেন লক্ষ্মণ।সেই সুযোগে  ঋষির রূপ ধরে রাবণ এসে কিডন্যাপ করলেন সীতাকে। এই ঘটনা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সীতার এই পর পুরুষের স্পর্শ যে এই প্রথম  তা কিন্তু নয়। এর আগেও একবার সীতা কিডন্যাপ হতে হতে বেঁচে যান। নিশ্চয়ই কৌতূহল বাড়ছে । তাই তো?তাহলে বলি সে ঘটনা।

রামচন্দ্র,ভ্রাতা লক্ষ্মণ ও সীতাকে নিয়ে তখন দন্ড কারণ্যের বনে। এই বিশাল বনভূমি ছিল বর্তমানের মধ্যপ্রদেশ, উড়িশ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের  এলাকা জুড়ে।
বনবাসে আসার সময় রাম চাননি বিপদসংকুল পথে নারীর উপস্থিতি। তাই বারবার মানা করেছিলেন। কিন্তু সীতা শোনেননি। বনবাসের এক পর্যায়ে রামচন্দ্র ভ্রাতা ও স্ত্রীসহ এলেন দন্ডকারণ্যের বনে। সেই বনে বাস করত রাক্ষস  যব ও রাক্ষসী শত হ্রদার পুত্র রাক্ষস বিরাধ। তার অস্ত্র ছিল একটি ত্রিশূল। সেই  ত্রিশূলে তিনটি সিংহ ,চারটে বাঘ,দুটো  
নেকড়ে, দশটা হরিণ ও একটি হাতির মাথা গাঁথা। শরীর ছিল তার পর্বতের মত সুবিশাল।বনের পথে হেঁটে চলেছেন তিনজন। হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এলো রাক্ষস বীরাধ। সুন্দরী সীতাকে দেখে কোলে তুলে নিল সে। রাম লক্ষ্মণ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে গেলো ঘটনাটা।বাল্মীকি লিখেছেন,এই প্রথম সীতা পরপুরুষের স্পর্শ পেলেন। তাও ঘটলো আর্য পুত্রদ্বয় রাম ও লক্ষ্মণের উপস্থিতিতে। 
রাম অবশ্য রাক্ষসের পথের গতি রোধ করে বললেন, কি তব পরিচয়। সে জানালো তার  পরিচয়। এবং এও জানালো কেউ তাকে অস্ত্র দিয়ে মারতে পারবে না।কেননা সে স্বয়ং ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত।
বাল্মীকি লিখছেন, রাক্ষস বিরাধ আসলে শাপগ্রস্থ গন্ধর্ব। সে যুগে দেব সভায় এরা নৃত্যগীত করতেন। বিখ্যাত গন্ধর্ব ছিলেন হাহা,হুহু, হংস,বিশ্ববায়ু,তম্বুরু,প্রমুখ।রাক্ষস বিরাধ ছিল এই তম্বু রু।  দেবসভায় তিনি এক নৃত্যগীত এর অনুষ্ঠানে গপ্পে মশগুল ছিলেন অপ্সরা রম্ভার  সঙ্গে। দেবরাজ ইন্দ্র তো রেগে  অগ্নিশর্মা। দিলেন অভিশাপ ।যাও মর্ত্যলোকে। রাক্ষস জন্ম নিয়ে। কোনদিন রামচন্দ্র যদি এসে তাকে বধ করেন, তবেই মিলবে মুক্তি।শাপমুক্ত হবেন গন্ধর্ব। তাই রাক্ষস এসেছে সীতা হরণে। রাম কিন্তু জানতেন না যে বাণবিদ্ধ করে    রাক্ষসকে বধ করা যাবে না।বেশ কিছু শক্তিশালী বাণ  ছোঁড়েন রামচন্দ্র। স্বাভাবিক ভাবেই রাক্ষসের মৃত্যু হলো না। আহত রাক্ষস সীতাকে কোল থেকে নামিয়ে রাম লক্ষ্মণকে দুহাতের মুঠোয় নিয়ে গভীর জঙ্গলে হাঁটা দিল। সীতা বিপদ বুঝে জোড়হাতে রাক্ষসের কাছে স্বামী রাম ও দেবর লক্ষ্মণের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। এই ব্যাপারটা বোধহয় রামের  ইজ্জতে  লাগলো। তিনি  ও লক্ষ্মণ প্রাণপণ শক্তি দিয়ে দেহের সর্বশক্তি দিয়ে রাক্ষসের হাত ভেঙে দিলেন।তারপর মাটির গর্তে জীবন্ত সমাধি দিলেন রাক্ষস বিরাধকে। রাক্ষস রামকে প্রণাম জানিয়ে চোখ বুজলো। এই ছিল সীতাহরণের প্রথম গপ্পো। এরপর রাবণ। তিনিও নাকি রাক্ষস। রাক্ষস মানে কি? অনেকগুলি অর্থ।নরখাদক কুৎসিতদর্শন  নিশাচর প্রাণী। অবশ্যই আর্য যজ্ঞনাশকারী অনার্য জাতি বিশেষ। মূলত এটাই ঠিক।ভারতের বনবাসী কালো চামড়ার স্বল্পবাসধারী ভূমিপুত্র। এদেশে উড়ে

এসে জুড়ে বসা আর্য সম্প্রদায় এর মুনি ঋষিরা বনে গড়ে তোলে আশ্রম। সেখানে মণ মণ কাঠ পুড়িয়ে ঘি পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করে  যজ্ঞের নামে গলা ফাটিয়ে মন্ত্র চ্চারণ করে বনের নিস্তব্ধ পরিবেশ নষ্ট করত।  যা পছন্দ ছিল না বনবাসীদের। তাই তারা দলবদ্ধ ভাবে আশ্রমে আক্রমণ করে যজ্ঞ পন্ড করে দিত। ব্যাকরণে রাক্ষস শব্দের অর্থ কি? রাক্ষস রক্ষ ধাতু থেকে উৎপন্ন শব্দ। অর্থাৎ রাক্ষস শব্দের অর্থ রক্ষাকর্তা।কিন্তু আর্য আগ্রাসনে সেই শব্দের বিকৃত মানে দাঁড়ায় নিকৃষ্ট কিছু। ঠিক যেমন অসুর শব্দ। যার অর্থ বীর।মহাশক্তিশালী। আমরা তাই বলি আসুরিক শক্তি। কিন্তু বৈদিক বিকৃতি হিন্দু ধর্মে এসে  মানে হলো অশুভ শক্তি। এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে পুজো হচ্ছে করোনা সুরের।এক নতুন অশুভ শক্তির  নতুন নামকরণ হলো।

ফিরে যাই রাক্ষস প্রসঙ্গে। অনেকেই বলেন রাবণ  ব্রাহ্মণ। তাহলে তিনি রাক্ষস হন কীকরে? এই রহস্য খুঁজতে পুরাণ ঘাঁটতে হবে।
পুরাণ বলছে, লঙ্কানিবাসী তথাকথিত কালো চামড়া অনার্যদের সঙ্গে আর্য প্রতীক বিষ্ণুর প্রবল যুদ্ধ হয়।নগরজীবনে অভ্যস্ত অনার্যরা যুদ্ধ প্রায় ভুলে গিয়েছিল। সভ্য হয়ে ওঠার গুনেগার দিতে পরাজিত হয়ে অনার্য দের পাতালে চলে যেতে হয়।পাতাল? সেতো পৃথিবীর নিম্নভূমি। তারপর থেকে অনার্যদের বাসস্থান হয় ভারতের নিম্নভূমি। সেই পাতালের শুরু বিহার থেকে শুরু করে ঝাড়খণ্ড হয়ে বাংলার গঙ্গাসাগর। তাই হিন্দু শাস্ত্রে এই অঞ্চলকে বলা হয়েছে মেলেচ্ছ ভূমি। এই পরাজিত রাক্ষসদের অন্যতম ছিলেন সুমালী। তাঁর সুন্দরী কন্যা কৈকষী। সুমালী চাইলেন, তাঁর কন্যার স্বামী হোক ঋষি বিশ্রবা। এই ঋষি ছিলেন রাজর্ষি তৃণবিন্দুর কন্যা হর্বিভুর গর্ভজাত। অর্থাৎ ক্ষত্রিয় মাতা। সে অর্থে ঋষি ব্রাহ্মণ নন। বিয়ে সম্পন্ন হয়। বৈশাখ মাসের প্রচণ্ড গরমে স্ত্রী পুত্র কামনা করায় ঋষি স্ত্রী কৈকষীকে বলেন, তোমার এই পুত্র হবে ক্রুর।হিংস্র। সেই পুত্র নাকি রাবণ।পাঠক ভেবে দেখুন,বৈশাখের গরমে জন্মান তাই রাবণ ক্রুর।কিন্তু এযুগে রবীন্দ্রনাথও জন্মেছেন বৈশাখ মাসে। যাক সেসব কথা। কৈকষী আর ভুল করেননি। পরের পুত্র আর প্রখর গ্রীষ্মে কামনা করেননি। ফলে সেই পুত্র হলেন ধর্মশীল। বিভীষণ। রাম জীবনের শুরুতে কুলগুরু বিশ্বামিত্রের আদেশে  দ্বিধায় থেকেও নারী হত্যা করেন।তাড়কা রাক্ষসী তার নাম। কি তার অপরাধ? ঋষি মুনিদের যজ্ঞ পন্ড করা। কেন করত সে? সে কথা তো আগেই বলেছি।

No comments:

Post a Comment