সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কুসংস্কার মানুষের জন্মগত অধিকার। বিশ্বের সব দেশেই বহু মানুষ কোনও না কোনও
কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। দৈনন্দিন জীবনে কিছু না কিছু ক্ষেত্রে।এমনকি বিজ্ঞান যাঁদের পেশা তাঁরাও বাদ নেই।
এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাসের অতিমারী নতুন এক কুসংস্কারের জন্ম দিয়েছে।খবরে প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গে কোনও কোনও এলাকায় করোনাসুর নামে এক অপদেবতার পুজো হচ্ছে।পুজোর উপচারে ব্যবহৃত হচ্ছে ফুল,মালা,ঘট,কলা,ফলমূল।
শহরাঞ্চলে শিক্ষিত মানুষ বলছে গো করোনা গো।গ্রামাঞ্চলের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ বলছে ,হে করোনাসুর তুমি মুক্তি দাও। ইতিমধ্যে গুজরাটের এক মন্দিরের কর্মচারী রবীন্দ্র সুইগামের ভবানী মাতার মন্দিরে সেবাইত , তিনি বলেন,স্বপ্নাদেশ পেয়ে নারবেট এলাকার নাদেশ্বরী মন্দিরে তিনি যান।ব্লেড দিয়ে নিজের জিভ কেটে ফেলেন। সবই নাকি দেবীর আদেশে। শেষ পর্যন্ত প্রশাসন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে।
![]() |
স্বপ্নাদেশ পেয়ে নিজের জিব কেটেছেন এই মন্দিরের সেবায়েত। |
![]() |
শ্রীরামপুরে শি ল নোড়া পুজো। |
প্রধানমন্ত্রী যে রবিবার ঘরের আলো নিভিয়ে দেশের সংহতি পালনের ডাক দেন, সেদিন হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে চন্দ্র মোহন রায় লেনের একটি বাড়িতে রান্না হচ্ছিল। মসলা বাটা হচ্ছিল শিলনোড়ায়। হঠাৎ নাকি শিলের ওপর দাঁড়িয়ে যায় নোড়া। ব্যাস।তুলসিতলায় সেই শিল রেখে শুরু হয়ে যায় পুজো। মোবাইলে সেই পুজো ভাইরাল হয়। বি জে পি রাজ্য নেতা দিলীপ ঘোষ বলেন, গ্রহরাজ শনির প্রকোপে করোনা হচ্ছে।
![]() |
করোনা সুর পুজো |
কমিউনিস্ট চিনেও হাজার কুসংস্কার।সেখানকার মহিলারা সান ইটিং করেন।প্রখর রোদে মাথায় ছাতা ধরে মুখে মাস্ক পড়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিশ্বাস , টানা ৪৫ মিনিট তাকিয়ে থাকলে ক্ষিদে কমবে।দৃষ্টিশক্তি বাড়বে। ঘুম ভাল হবে। ওজন কমবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন , এই বিশ্বাস বিপদজনক। এতে দৃষ্টিশক্তি যেমন চলে যেতে পারে, তেমন ত্বকের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। লেটুস পাতা উপকারী। কিন্তু ১৯শতকের ইউরোপের মানুষ সন্তান জন্মদানের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিনগুলিতে লেটুস পাতা খাওয়া অমঙ্গল মনে করতেন।
![]() |
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চার্বাক ঋষি |
ইউনিভার্সিটি অফ ওয়ার উইক থেকে কিম্বারলি ওয়েডের নেতৃত্বে সাতজনের এক গবেষক দল বলেছেন, কল্পিত,অদেখা,বা কখনও না ঘটা বিষয়ের ওপর মানুষ অন্ধবিশ্বাস থেকে এমন সব উদ্ভট তথ্যকে বিশ্বাস করতে এবং সত্য ভাবতে শুরু করেন যার সাথে বাস্তবের যোগ নেই।গবেষকদের দাবি, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গুজব ও ছোট বয়স থেকে মস্তিষ্কে জমা হওয়া অলীক তথ্য মানুষ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস শুধু নয়, সত্য বলে ভাবতে শুরু করে। বি জে পি সরকার কায়েম হওয়ার পর থেকে গরু নিয়ে এক তুলকালাম ঘটনা ঘটতে থাকে দেশজুড়ে।বাঙালির প্রতীক রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঘরেবাইরে উপন্যাসে নিখিলেশের মুখ দিয়ে বললেন, কেবল গরুই যদি অবধ্য হয়, আর মোষ যদি অবধ্য না হয়, তবে এটা ধর্ম নয়। ওটা অন্ধ সংস্কার। রবি কবি এও বলেছেন, আজ হিন্দু জাতি জ্ঞানে অজ্ঞানে, আচারে অনাচারে, বিবেকে এবং অন্ধ কুসংস্কারে এমন একটা অদ্ভুত মিশ্রণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
![]() |
গো মূত্র খেয়ে অসুস্থ জনৈক ব্যক্তি |
এদেশে কি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রাচীন যুগে প্রতিবাদ হয় নি? হয়েছে। বৈদিক যুগে চার্বাক এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে যুক্তিবাদী দর্শন। হেতুবাদী এই দর্শনকে রোধ করে সংখ্যাগুরু বৈদিক ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষজন। জন্মান বুদ্ধদেব, মহাবীর, আজি বিকাশ গোষ্ঠী, কেশ কম্বলিন,পুকুথ কাত্যায় ন । যাঁরা বেদ ব্রাহ্মণ্যবাদের সৃষ্টি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বিদেশেও লড়তে হয়েছে পিথা গরাসকে।লড়তে হয়েছে সক্রেটিস, প্লেটো , অ্যারি স্ততল , গ্যালিলিও, ব্রুনো কে। যুক্তিবাদী আন্দোলনে আজও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কিছু মানুষের লড়াই জারি আছে।কিন্তু রাষ্ট্রের উদাসীনতা সেই আন্দোলনকে ধীর গতি করে দিচ্ছে। বিরুদ্ধবাদীদের হাতে খুন হচ্ছেন পানসারে, দাভলকর, কালবুরগি এবং গৌরী লঙ্কেশের মত যুক্তিবাদীদের। বাংলাদেশে মরতে হচ্ছে অভিজিতের মত যুবক ব্লগারদের। এখনও অনেক মানুষের কাছে যুক্তিবাদ বিষয়টি বোধগম্য নয়। মনে রাখতে হবে, যুক্তিবাদের বিপরীত শব্দ ভাববাদ। এই ভাববাদ অধ্যাত্ব বাদের আঁতুড়ঘর। যে আঁতুড়ঘরে তৈরি হয় সংস্কার।যার অধিকাংশই কুসংস্কার।এমনটাই দাবি , যুক্তিবাদীদের। করোনা সংকটের সময় মানুষের উচিত, বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা।প্রশাসনের নির্দেশ মানা।কুসংস্কারে বশবর্তী হয়ে এমন কিছু নেতিবাচক পদক্ষেপ না নেও়য়া, যাতে বৃহত্তর মানব স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়।
No comments:
Post a Comment