কলকাতা বন্দরের কাছাকাছি মুসলমান-প্রধান খিদিরপুরের মুন্সিগঞ্জ এলাকায় সেই পূজার খোঁজ বাইরের মানুষ খুব একটা রাখেন না হয়তো।
কিন্তু পাড়ার মানুষের কাছে ঈদের মতোই উৎসবের সময় দুর্গাপূজা বা কালীপূজা।
দুর্গাপূজা আদতে হিন্দু বাঙালীদের সবথেকে বড় উৎসব হলেও কালে কালে তা অন্যান্য ধর্মের মানুষের কাছেও হয়ে উঠেছে উৎসবের সময়।
পূজার সময়ে হিন্দুদের মতোই মুসলমান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন - সকলেই মেতে ওঠেন উৎসবে। অনেক জায়গায় পূজার উদ্যোগেও জড়িয়ে থাকেন নানা ধর্মের মানুষ, যেমনটি মুন্সিগঞ্জের এই আয়োজন।তিন রাস্তার মোড়ে বেশ সাদামাটা প্যান্ডেল। বাহুল্য খুব একটা নেই।
পূজার কদিন আগে প্যান্ডেল তৈরি করে তার পাশেই চলছিল দুর্গাপ্রতিমা গড়ার শেষ মুহূর্ত কাজ।
সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট সলমান সর্দার।
উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল বিরাট হাঁ করে থাকা দুর্গার বাহন সিংহের মুখের মধ্যে দিয়ে ভেতরে কিছু দেখা যায় কিনা।
সলমন বলছিল, "দুগ্গাপূজোয় খুব মজা হয়। ঠাকুর দেখতে যাই। ফুচকা আর আইসকিরিমের দোকান বসে, খাই - দোলনায় চাপি। আবার আমাদের পূজোয় চলে আসি।"
এই পূজাটাকে সলমান যেমন ছোটবেলা থেকেই 'আমাদের পূজো' বলে ভাবতে শিখেছে, তেমনই নিজেদের পূজা বলেই মনে করেন পাড়ার সবাই।"ষাট বছর ধরে এভাবেই পূজা হয়ে আসছে। আমাদের মামা, দাদাদের দেখেছি সকলে মিলে দুর্গাপূজা-কালীপূজা-ঈদ-মহররম পালন করতে, আমরাও সেভাবেই করি। আবার আমাদের জুনিয়ার যারা বড় হয়েছে, তারাও পূজার কাজে এগিয়ে আসে। চাঁদা তোলা, ঠাকুর নিয়ে আসা, ভাসান দেওয়া - সবেতেই সবাই থাকি," বলছিলেন পূজা কমিটির প্রধান প্রেমনাথ সাহা।
মি. সাহা বলছেন, "এই তো মহরম গেল। আমরাও বাজার করেছি, খাবার বিলি করেছি, জল দিয়েছি। কখনও কোনও সমস্যা হয় না এ পাড়ায়"।
"৯২ এর বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে যখন সারা দেশ জ্বলছিল, তখনও এ পাড়ায় তার আঁচ পড়ে নি।"
পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলেন পূজার আরেক উদ্যোক্তা শেখ বাবু।
এগিয়ে এসে বললেন, "ঠাকুর নিয়ে আসতে যাই আমরা, প্যান্ডেলে ঠাকুর তোলা, দেখভাল - সবই মুসলমানরা করি হিন্দু ভাইদের সঙ্গে। কিন্তু প্রতিমার কাছে যারা পূজায় বসেন তারা হিন্দু, কারণ সেই কাজে তো মন্ত্র লাগে! আমি তো আর মন্ত্র জানি না!"
শাস্ত্র বা মন্ত্র না জানলেও পূজার ব্যবস্থাপনায় পাড়ার মুসলমান ছেলেরাই সামনের সারিতে।
প্যান্ডেল-কর্মীদের কাজ দেখভাল করছিলেন যে কয়েকজন, তাদেরই অন্যতম মুহম্মদ নাজিম তারা কেউ একটা জাত বা ধর্মেরতো নয়। আবার যারা আসেন এ পাড়ায়, তারাও নানা জাত-ধর্মের। তাই আমাদের পাড়ায় জাতপাত-হিন্দু-মুসলিম ব্যাপারটাই নেই। একটা হিন্দু বাড়ির বাচ্চা আর মুসলিম বাড়ির বাচ্চা ছোট থেকেই একসঙ্গে বড় হয় - তারা এই ভাগাভাগিটা ছোট থেকেই দেখে না। আমরাও যেমন ছোট থেকে এভাবেই বড় হয়েছি," বলছিলেন মুহম্মদ নাজিম।
পূজা এসেই গেল বলতে গেলে, কিন্তু সবার কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়নি। তাই ভরদুপুরেই চাঁদার বিল নিয়ে বের হলেন কজন তরুণ।
কানে এলো তারা দোকানীদের বলছেন, "বছরে একবারই দুর্গাপূজা। একটু বুঝেশুনে চাঁদাটা দেবেন কাকা। তবে আপনার যা মন চায় তাই দেবেন।"
সেই চাঁদা তোলার দলেরই একজন মুহম্মদ সেলিম।
বলছিলেন,"আগে আমাদের পূজায় আর্টিস্ট এনে শো হত। এখন খরচ এত বেড়ে গেছে, সেসব বাদ দিতে হয়েছে। পাড়া প্রতিবেশী আর রাস্তা থেকে চাঁদা তুলে এক লাখ ২০ হাজার টাকার মতো ওঠে। তাই দিয়েই পূজা করতে হচ্ছে।"
কিন্তু আর কতদিন নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে শুধু চাঁদা তুলে পূজা চালিয়ে যেতে পারবেন, সেই চিন্তা রয়েছে মুন্সিগঞ্জের এই পাড়ার বাসিন্দাদের।
পরে কী হবে, তা নিয়ে অবশ্য এখন আর ভাবতে চান না তারা, আগে এবারের পূজার কটাদিন তো আনন্দে কাটুক!
সূত্রঃ বিবিসি (আর্টিকেল ও ছবি)
No comments:
Post a Comment