মনোরঞ্জন ব্যাপারিঃ যুদ্ধের ময়দানে বেঁচে থাকা এক যোদ্ধা - Songoti

মনোরঞ্জন ব্যাপারিঃ যুদ্ধের ময়দানে বেঁচে থাকা এক যোদ্ধা

Share This
দেবপ্রিয় মণ্ডলঃ ১৯৫০ সাল। তখন বাংলাদেশ থেকে দলে দলে ভারতে আসছে রিফিউজিরা। এমনই এক নমশুদ্র মহিলা ভারতে আসার সময় ট্রাকের মধ্যেই জন্ম দিলেন এক শিশুপুত্রের। তখন শরনার্থী শিবিরগুলিতে যে ভাত দেওয়া হত তাতে পচা গন্ধ থাকত। তাই খেয়েই বড় হয়ে ওঠা। তখন ডিসেন্ট্রি (উদরাময়) ছড়িয়ে পড়েছে শিবিরে। অনেক শিশুদের সঙ্গে সংক্রামিত হল সেই শিশুটিও। বাকিদের মত তাকেও মৃত ধরে নিয়ে শুরু কবর খোঁড়া। সেখান থেকে কোনোরকমে বেঁচে ফেরা। তারপর গোরু চরানোর কাজ জোটে এক ব্রাহ্মণ বাড়িতে। নমশুদ্ররা যে অস্পৃশ্য, প্রথম বুঝতে পারে ছেলেটি। এরই মধ্যে খিদের জ্বালায় মারা যায় ছেলেটির বাবা ও বোন। পোষাক বলতে ছিল একটা গামছা। তার মা লজ্জা ঢাকার জন্য ব্যবহার করতেন মশারি। ছেলেটি বুঝল বাঁচতে হলে তাকে পালাতে হবে। পালাল সে। প্রথমে কলকাতা, তারপর জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে অসমের চায়ের দোকানে। গল্পটা লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারির জীবনের গল্প। “চায়ের দোকানে কাজ করতে করতে খদ্দেরদের গল্প গোগ্রাসে শুনতাম। এইভাবেই জানতে পারি নকশালদের সম্পর্কে। ওদের লড়াইটাও ছিল খিদের বিরুদ্ধে” বলছিলেন লেখক। “এরপর ফিরে আসি কলকাতায়। বাড়ির লোক আমি বেঁচে আছি জেনে খুশি হয়। কিন্তু লড়াইটা ছিলই। অতএব একদিন হাতে এসে পড়ে পাইপগান, বোমা আর ছুরি। তারপর ধরা পড়ি। জেলে গিয়ে শুরু হয় অক্ষরের সাথে পরিচয় করার পালা। ক্রমে কম বেশি চারশ বই পড়ে ফেলি এবং একদিন ছাড়া পাই। রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি কলকাতায়। বই পড়তে পড়তে একদিন ‘জিজীবিষা’ শব্দটা পাই। কিছুতেই মানে বুঝতে পারছিলাম না। একদিন জ্যোতিষ রায় কলেজ থেকে একজন মহিলা আমার রিকশায় উঠলেন। দেখে মনে হল অধ্যাপিকা। জিজ্ঞেস করলাম শব্দটার অর্থ। কথায় কথায় উনি জেনে নিলেন আমার জন্ম, ইতিহাস, পড়াশুনো ইত্যাদি। বললেন, “আমার পত্রিকায় লিখবে?” ঠিকানা নিয়েই চমকে উঠলাম। এই সেই ‘হাজার চুরাশির মা’এর লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী! এক্মাস ধরে প্রচুর কাগজ নষ্ট করে অবশেষে একটি গল্প লিখলাম। বর্তিকা’তে ছাপা হল ‘রিকশা চালাই’ শিরোনামে” ব্যাপারি ১৬টি বই লিখেছেন। লিখেছেন অসংখ্য রাজনৈতিক প্রবন্ধ। ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’ বইটির অনুবাদক অরুনাভ সিংহ বলছেন, “ব্যাপারীর নিজের মতো করেও বেঁচে থাকার লড়াই দেখে প্রত্যেকেই তার সাথে এক অসাধারণ সহানুভূতি পেয়েছে। তিনি তাঁর সমস্ত কল্পকাহিনীতে তাঁর নিজস্ব অনন্য অভিজ্ঞতাকে পূর্বাভাস দিতে পারতেন, তবে তিনি এই পরিবর্তে এই সমস্ত লোকের গল্প বলতে বেছে নিয়েছিলেন যারা সকলেই লড়াই করে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেছিল”। সম্প্রতি অ্যামাজন ওয়েস্টল্যান্ড তাঁর ১৪টি বইয়ের কপিরাইট কিনে নিয়েছে। এগুলি ইংরেজি সহ আটটি ভাষায় অনুবাদ করা হবে।

২০১৮এর জানুয়ারি মাসে ‘দ্য হিন্দু’র সেরা লেখক বলে বিবেচিত হয় তাঁর নাম। সত্তর ছুঁইছঁই মানুষটি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, “এই আনন্দ শুধু আমার নয়, যাদের বঞ্চিত করা হয় তাদের সকলেরই”।

ব্যাপারি এখন সংসার করছেন। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সুখেই আছেন তিনি। মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন কিছুদিন আগে। বাড়িটা সারাচ্ছেন। তবে এখনও দিনের বেশিরভাগ সময় কাটান ল্যাপটপে টাইপ করে। এখনও লিখে চলেছেন এই ‘লেখোয়াড়’। যোদ্ধাদের গল্প বোধহয় বলে শেষ করা যায় না।

No comments:

Post a Comment