যিশুর জন্ম মৃত্যু ও বিবাহ নিয়ে বিতর্ক কেন? - Songoti

যিশুর জন্ম মৃত্যু ও বিবাহ নিয়ে বিতর্ক কেন?

Share This

শ্রীজিৎ চট্টরাজ : বছর শেষে আবার ফিরে এলো বড়দিন। প্রভু যিশুর জম্মদিন। খ্রিষ্টান ধর্মের এক পবিত্র দিন। আজ পৃথিবীতে ধর্মমত নির্বিশেষে এই দিনটি পালিত হয় উৎসবের দিন হিসেবে। কিন্তু আবহমান এই শহরে যিশুর জন্মদিন,মৃত্যুদিন ও বিবাহ নিয়ে বিতর্ক একটা থেকেই গেছে।


খ্রিষ্টান ধর্মের দুটি ধর্মগ্রন্থ। ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্ট। যিশুর জন্মের আগের ধর্মীয় আখ্যান নিয়ে রচিত ওল্ড টেস্টামেন্ট। যেখানে পৃথিবীর সৃষ্টি ইতিহাস থেকে প্রলয়ের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত হয়েছে ঈশ্বরের পুত্র যিশুর জন্মবৃত্তান্ত থেকে মৃত্যু আর তাঁর ধর্মীয় বাণী, কর্মকাণ্ড। আদি বাইবেল অর্থাৎ ওল্ড টেস্টামেন্টে বিশ্বাসীদের বলা হয় ক্যাথলিক। নতুন বাইবেলের বিশ্বাসীরা পরিচিত প্রোটেস্ট্যান্ট হিসেবে।

ইতিহাস বলে, রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজারের আদেশে রোমানপ্রদেশে আদমশুমারি শুরু হয়। ফলে দেশের অন্য সব নাগরিকদের সঙ্গে সদ্য বিবাহিতা মরিয়ম স্বামী যোসেফসহ নাসরত গ্রাম থেকে চলে আসেন গালিল প্রদেশের বেথলেহেমে। বেথলেহেম  তখন লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের স্থান নেই।আসন্ন প্রসবা স্ত্রীকে নিয়ে বাধ্য হয়ে যোসেফ রাত টুকু কাটাতে এক ঘোড়ার আস্তাবলে আশ্রয় নেন।সেখানেই রাত বারোটায় জন্ম নেন খ্রিষ্টান ধর্মের ত্রাণকর্তা প্রভু যিশু।

  বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত আরাফাত প্রকাশনীর তাওরাত ইঞ্জিল ও বাইবেল গ্রন্থের লেখক এম এম সুলতান মাহমুদ লিখেছেন, "........... হজরত ঈশার জন্মের পনেরো বছর পর কুরীনিয় সিরিয়ার শাসন ক্ষমতায় আসেন সিজার। এই সময় তিনি রাজ্যের লোক গণনার নির্দেশ দেন। হজরত ঈসাকে দাউদের বংশের লোক অর্থাৎ রাজার বংশের লোক হিসেবে পরিচয় প্রদানের জন্য নাসরত গ্রাম থেকে আশি মাইল দূরে বেথলেহেমে গর্ভবতী মরিয়মকে আনার কাল্পনিক গল্প সাজানো হয়।

   এই গ্রন্থে হজরত ঈশা বা বিবি মরিয়ম সম্পর্কে ইহুদীদের যে অভিযোগ তা মারাত্বক। সেখানে বলা হয়েছে , হজরত ঈশা অর্থাৎ যিশু কুমারী মা মেরী বা মরিয়মের  সন্তান। কুমারী কি করে সন্তানের মা হন? নিউ টেস্টামেন্ট বলে, যিশুর পিতা মরিয়মের স্বামী যোসেফ নন। যিশুর জন্মের পেছনে কাজ করেছে পরমাত্মা ঈশ্বরের দৈবিক শক্তি। ইহুদিদের বক্তব্য, যিশুর মা মরিয়ম সত্য।যোসেফ যে তাঁর জন্মদাতা পিতা নন, এও সত্য। যিশুর পিতা আসলে রোমান এক সৈনিক প্যান্ডেরা। যিনি মরিয়মের প্রেমিক ছিলেন। কোথাও বলা হয়েছে,মরিয়ম থাকতেন ইয়াহুদা প্রদেশে। সেখানে রোমান সেনারা আক্রমণ করে। প্যানডোরা নামে এক রোমান সৈনিক মরিয়মকে ধর্ষণ করায় মরিয়ম অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এমন তথ্য নাকি ২০০২সালে বৃটেনে বিবিসিতে এক প্রামাণ্য তথ্যচিত্রে প্রচারিত হয়।

    যিশুর  জন্মদিন কবে তাই নিয়েও বিতর্ক আছে। যিশুর জন্মের ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর জন্মদিন পালিত হতো না। ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে পোপ জুলিয়াস প্রথম২৫ ডিসেম্বর জন্মদিন পালন শুরু করেন। ২৭৪ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট অর্লিন ২৫ ডিসেম্বর তারিখটি সূর্য দেবতার জন্মদিন পালন শুরু করেছিলেন। গ্রিকরা তাঁদের দেবতা জিউস এর জন্মদিন পালন করেন ২৫ ডিসেম্বর। ঐতিহাসিক এডোয়ার্ড গীবন তাঁর 'ইন ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দ্যা রোমান এম্পায়ার' গ্রন্থে লিখেছেন, "দি রোমান ক্রিস্টিয়ানস্ ইগ্নরেন্ট অফ হিস (ক্রায়েস্ট) বার্থ। ফিক্সড দি সোলেম ফেস্টিভ্যাল টু দি টুয়েন্টি  ফিফ্থ অফ ডিসেম্বর দি ব্রুমালিয়া, অর উইন্টার সলাটিস, হোয়েন দি পেগানস আনুয়ালি সেলিব্রেটেড দি বার্থ অফ সোল"। অর্থাৎ রোমান খ্রিষ্টানরা যিশুর প্রকৃত জন্মতারিখ না জেনে তাঁরা প্যাগানদের দেবতা সূর্যের জম্মদিন ২৫ ডিসেম্বর 'ক্রিসমাস ডে' হিসেবে উদযাপন করছে।

    বাইবেল মতে যিশু ছিলেন, অবিবাহিত।কিন্তু ইহুদীরা নাকি যিশুকে অপবাদ দিয়েছেন বিবাহিত হিসেবে।এমনকি প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান পণ্ডিত মার্টিন লুথার তাঁর 'টেবিল টক' গ্রন্থে লিখেছেন, হজরত ঈশা (যিশু)ছিলেন।সুসমাচার লেখক লূক (৭ ৩৭:৫০) এ আছে,নবীর প্রিয় শিষ্য ম্যারি ম্যাগদালিনকে একজন পাপী মহিলা মনে করতেন, যিনি তার মাথার চুল দিয়ে হজরত ঈশা এর পায়ের ঘাম মুছে দিয়েছেন, পায়ে আতর ঢেলেছেন ও চুম্বন করেছেন।

 (তাওরাত ইঞ্জিল ও বাইবেল,প্রকাশক: আরফত প্রকাশনী,ঢাকা,বাংলাদেশ,পৃষ্ঠা৭৬)।

   অর্থাৎ বাইবেলে  ম্যাগদালিন নামে একটি চরিত্রের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়। বিষয়টি গুরুত্ব পায় ১৯৮০সালে।জেরুজালেমের পূর্ব দিকে তালপিয়েট অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া গেছে পাথর কেটে তৈরি এক সমাধি ক্ষেত্র।ইজরায়েলের ভূতাত্ত্বিক আরইয়েহ শিমরোন দাবি করেছেন, সমাধি ক্ষেত্রে শায়িত শবাধারের লিপির পাঠোদ্ধার করে তিনি নিশ্চিত যে এই সমাধিই যিশুর পারিবারিক সমাধি।

   ২০০৭সালে এই সমাধি ক্ষেত্র নিয়ে এক তথ্যচিত্র বানান পরিচালক জেমস্ ক্যামেরন। তিনিও বলেছেন, মোট দশটি শবাধারের দুটিতে তিনি যিশু ও মেরি ম্যাগদেলেনের নাম পেয়েছেন। অন্য দুটি সমাধিতে লেখা আছে যিশুর পুত্র জুডা ও যিশুর ভাই জেমস্ এর নাম। বাকিগুলিতে পরিবারের অন্য সদস্যদের নাম। তাঁর দাবি, যিশুর কবর থেকে পুনরুত্থান হতে পারে না। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যিশুর পাশে একটি শবাধারে মেরি ম্যাগদালেনের নাম লেখা শবাধার মেলে। এদিকে নিউইয়র্কে জনৈক সুজান ওলসন দাবি করেছেন, তিনি যিশুর ৫৯ তম পুরুষ। তিনি বলেন,যিশুর মৃত্যু নিয়ে যা তথ্য প্রচলিত তা মিথ্যা। আহত যিশু শিষ্যদের সহযোগিতায় ভারতে কাশ্মীরের পথ ধরে পালিয়ে আসেন। কাশ্মীরের মাটিতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কাশ্মীরের রোজাবেল যিশুর আসল সমাধি। যিশুর পুনরুত্থানকে হিব্রু ভাষায় বলে চিজা। যিশুর মাতৃভাষা ছিল আরামিক। যার অর্থ, আরোগ্যলাভ। অনেকেই মনে করেন,ক্রুশবিদ্ধ যিশু মারা যাননি। তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করার পর সন্ধ্যা হয়ে আসে । রাজা হেরোদের সেনারা যিশু মৃত মনে করে রাজপ্রাসাদে ফিরে যায়।ঘটনাস্থলে হাজির শিষ্যরা মৃতপ্রায় যিশুকে এক গুপ্ত জায়গায় লুকিয়ে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন। তাঁর শরীরের পেরেকবিদ্ধ  ক্ষতস্থান মস্তকি আর অ্যালাভেরা ভেজষ দিয়ে চিকিৎসা করেন।তারপর শিষ্যদের সাহায্যে যিশু পালিয়ে আসেন ভারতে। কিভাবে ভারতে পালিয়ে আসেন,সে এক অন্য কাহিনী।

1 comment: