মা এলেন কোথা থেকে ? - Songoti

মা এলেন কোথা থেকে ?

Share This
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় ; খোকা মাকে শুধায় ডেকে, এলেম আমি কোথা থেকে? স্বাভাবিক ভাবে আমাদের মনেও তো প্রশ্ন উঠতে পারে মা এলেন কোথা থেকে?
আজ বিশ্ব  মাতৃদিবস। এই প্রতিবেদন উৎসর্গ করলাম আমার গর্ভধারিনী মা এবং বিশ্বের সব মাকে। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মার্কিন দেশে মাতৃদিবস পালনের সূচনা করেন আনা জার্ভিস। বলা হয় , প্রাচীন গ্রিসে গ্রীক দেবী সিবেল এর আরাধনার দিন।ক্যাথলিক মতে, মে মাসের চতুর্থ রবিবার এই মাতৃদিবস পালিত হয় ইংল্যান্ডে। বলা হয় লেতারে সানডে। আধুনিক যুগে ঘরকন্নার কাজে  মায়েদের এদিন ছুটি দেওয়া হয়। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর একটা প্রতীকী ব্যবস্থা। সব কিছুই পালিত হয়, কিন্তু সঠিক অর্থে নারী জাতির প্রতি  কি আমরা আন্তরিকভাবে  শ্রদ্ধাশীল?থাক, এই বিতর্কে ছেড়ে আমরা বরং দেখি মা এলেন কোথা থেকে?


খ্রিস্টপূর্ব চারশ বছর আগের কথা।গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের  শৈশবকাল। দোলনায় রেখে তাঁকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন তাঁর মা অলিম্পিয়াস। সেদিকেই নজর পড়েছিল এক দার্শনিকের। তিনি বলে উঠেছিলেন, হ্যান্ড দ্যাট রকস দ্য  ক্র্যাডেল , রুলস দ্য ওয়ার্ল্ড। আসলে মানুষ বুঝেছিল, মা হলেন সেই অমোঘ শক্তির অধিকারিনী।হোমারের  ইলিয়াড ,ওডিসি মহাকাব্যে  মাতৃশক্তির কথা আছে ছত্রে ছত্রে। এদেশের অনার্য সংস্কৃতিতেও মাতৃ আরাধনার কথা আছে। বাঙালির মননে ধর্মে ।
পিছিয়ে যাই মানুষের  উন্মেষ মুহূর্তে। গুহাবাসী পুরুষ সমবায় পরিবারের প্রয়োজনে শিকারে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসত কখনও কখনও।সংখ্যা বৃদ্ধি । ফলে শিকারের হ্রাস। গুহায় খাদ্যের জন্য অপেক্ষারত নারী বুঝেছিল, সন্তানের মুখে খাদ্য তুলে দিতে পুরুষের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। সেদিন নারী শক্তি ঘর (গুহা)ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে খাদ্যের সন্ধানে।আবিষ্কার করে গাছের ফল।সন্তানকে দেওয়ার আগে নিজের চেখে দেখা। ভালো হলে ভালো। না হলে কত মাকে সেদিন বিষ ফল খেয়ে মরতে হয়েছে। নিজের জীবন দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে গেছে বিকল্প খাদ্যের সুলুক সন্ধান। ফল খাওয়া,বীজ ফেলা। তার থেকে নতুন গাছের সৃষ্টি দেখে নারী প্রথম শিখেছিল ফসল উৎপাদন।শুধু তাই নয়, অ্যাসেরীয় ও ব্যবলনীয় সভ্যতায় পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে সিংহ শিকারেরও  ইতিহাস আছে। আছে শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের ইতিহাস।
মিশরীয় ফারাও এর যুগে নারীরা অন্দরমহলে থেকেও রাজ্য শাসন করেছেন।আকবরের ধাত্রী মা হারেমের ভেতর থেকেও ভারত শাসন করেছেন উজিরে আলা বৈরাম খাঁ মারফৎ। শুনলে অবাক লাগবে, পৃথিবীতে পূর্ণ মানুষ আসার অনেক আগেই চুনা পাথরের মাতৃমূর্তি মিলেছে। ভাবছেন,মানুষ যদি না এলো, মূর্তি বানালো কে?


আমরা যে আধুনিক মানুষ ,আমাদের বৈজ্ঞানিক অভিধা হোমো স্যাপিয়েন্স স্যপিয়েন্স।যার কার্বন ডেটিং বয়স ৩৫ হাজার বছর। এর আগের পর্যায়ে ছিল প্রায় মানবেরা। তখন তো একদিকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর অন্যদিকে হিংস্র মাংসাশী প্রাণী ও বিশেষ করে জোড়া দাঁতওলা বাঘ অর্থাৎ স্যেবর টুথ টাইগারের ভয়ে তটস্থ। এই প্রায় মানবের পরবর্তী ধারা হোমো হ্যাবিলাস থেকে বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয়েছে মানুষ  হোমো ইরেক্টাস পর্যায়ে। এদের এক অংশ ছিল ফ্রান্সের লাদকোস অঞ্চলে পাহাড়ের গুহায়।এছাড়া স্পেনের আলতামিরা পাহাড়ের গুহার দেওয়াল এবং ছাদে প্রাকৃতিক রং দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করত ছবি এঁকেএই প্রায় মানুষেরা।ভারতবর্ষের মধ্যপ্রদেশের ভীম বেটকা পাহাড়ের গুহাতেও নিদর্শন মেলে। ফ্রান্সে মেলে চুনা পাথরের মূর্তি । বয়স প্রায় ৩০ হাজার বছর। দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটার। যা গ্রানাইট  বা ন্যিম জাতীয় শক্ত পাথর ঘষে খোদাই ।মূর্তিটি ছিল এক সন্তান সম্ভবা নারী।সেদিনের শিল্পী কিন্তু সে নারীর মুখ,চোখ,সৌন্দর্য্য সৃষ্টির চেষ্টা করেনি। তার বিস্ময় কাজ করেছিল নারীর স্তনযুগল। যা মাতৃত্ব রসে পরিপূর্ণ। বিশাল উদর। স্ফীত চেহারা। সেই শিল্পী  মাতৃমূর্তি নয়, সৃষ্টি মুহূর্তে নারীর অঙ্গ পরিবর্তনে অবাক হয়েছিল সেই প্রায় মানব শিল্পী। নিজের অজান্তেই সে সৃষ্টি করলো আসন্নপ্রসবার মূর্তি।নারীকে কি সে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল এই মূর্তি গড়ে? অথচ আমাদের দেশে মাতৃত্বের সম্মান পুরুষ সন্তান প্রসবে।
সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য গ্রন্থের ৩৮/৩৯পৃষ্ঠায় লিখেছেন,কন্যা অভিশাপ(ঐতেরেয় ব্রাহ্মণ,(৬/৩/৭/১৩) তাই সন্তানসম্ভবা নারীর একটি আবশ্যিক অনুষ্ঠান হলো পুংসবন। যার উদ্দেশ্য হলো যাতে গর্ভস্থ সন্তানটি যেন পুরুষ হয়। নারী মিথ্যাচারিনী ,দুর্ভাগ্যস্বরূপিনী সুরা বা দ্যুতক্রীড়ার মতো একটি ব্যসন মাত্র (মৈত্রায়িনী সংহিতা ১/১০/১১/৩/৬/৩)।
আমরা যে আর্য সনাতন ধর্ম নিয়ে গর্ব অনুভব করি, সেখানে নারী দেবীর কোনো স্থান ছিল না। পবন,বরুণ,ও সূর্যের উপাসনা হতো। তিন পুরুষ দেবতা।পরবর্তী সময়ে অদিতিকে এই তিন  মিত্র দেবতার জননী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা না মানলেও ঐতিহাসিক সত্য , আর্যদের আগমন ও এদেশীয় ভূমিপুত্র অনার্য সংস্কৃতি মিলনে সৃষ্টি       
হিন্দু জাতির। সাঁওতালদের  ঈশ্বর বিশ্বাস দেবদেবীর সৃষ্টি তত্ত্বে আদিমতম দেবতা হুরি।তিনি প্রচণ্ড হুরহুর শব্দে দ্রুত ঘূর্ণি থেকে সৃষ্টি। হুরির দুই স্ত্রী বিদিরানী ও লুখি। বিদিরানী বয়ন শিল্পের রানী। লুখি
কৃষি শস্যের। হিন্দু পুরাণে পাই হরির দুই স্ত্রী। সরস্বতী বিদ্যার ও প্রজননের দেবী। লক্ষ্মী কৃষিদেবী। ই ও জেমস্ তাঁর 'দ্য কান্ট অফ দ্য মাদার' গ্রন্থে এবং এই দেশের বহু ঐতিহাসিক তাঁদের গবেষণায় প্রকৃতিকে মাতৃরূপিনী শক্তি হিসেবে লিখেছেন। আজ আমরা যে মাতৃদেবীর মূর্তি গড়ে পুজো করি তা প্রাগৈতিহাসিক অনার্য ভারতের ভূমিপুত্রদের উত্তর সাধক হিসেবে করে চলেছি। মাতৃ ঋণ কোনদিন শোধ করার নয়।

No comments:

Post a Comment